Sunday, December 12, 2021

পাঠকামি - নিরুপম চক্রবর্তী


পাঠকামি - নিরুপম চক্রবর্তী


বহুদিন পরে আজ শীতের দুপুর । দিল্লির দূর দূরান্ত থেকে বিক্রিত হয়ে আসা মরলার সঙ্গে মটর শাকের অনবদ্য ব্যঞ্জন সহকারে কিছুটা অবসর কাটিয়ে বসা গেলো একগুচ্ছ কবিতার সঙ্গে । এই তো বকোদর, জীবনের এই তো আনন্দ, সপ্তাহান্তে একটুকরো রোদের জন্য এতোগুলো উইকডেজ রাতকালি করা ।  ঈষৎ রঙিন করে তোলা মুহূর্তগুলির অভিপ্রায়ে প্রবাসে বাংলা যাপন । কবিবন্ধুদের এই সামান্য আলাপ, কবিতার পাঠকামি ।  নিজস্ব পাঠ ও অনুচ্চারিত কিছু আনন্দের ছন্দলিপি । 

আজ, পাঠ হবে, কবি নিরুপম চক্রবর্তীর 'ইষৎ রঙিন' । গ্রন্থটি, সাময়িক কালে প্রকাশিত, ডাকযোগে সংগ্রহ করা । প্রকাশক সৃষ্টিসুখ । 


"বিচ্ছিন্ন বলতে চেয়ে কপ্ত বলে বিলুপ্ত শব্দটি

ছিন্নমস্তা ভাষা আজ ওষ্ঠে তাঁর ধরে রেখে দিল ।

হে ভাষা, জীবন্ত হও,  এ শ্মশানে শব সাধনার প্রমত্ত ধবনিটি জালো

তোমার বিচ্ছিন্ন অঙ্গ প্রতিটি নরকে দ্যাখো দোকান খুলে কীরকম বেঁচেবর্তে আছে । "


এই বলে ।। কপ্ত ।।  কবিতাটি শুরু হয় । ডবল দাঁড়ি দিয়ে নামকরণ । রেনেসাঁস পর্বের কবিতা । বলা যায়, এর আগে এই কবিকে আমি তেমন পড়িনি ।ব্যক্তিগত পরিচয়ও নেই।  ফেসবুকে, কিছু তার ভিলানেল পড়েছি । কবিতাটা আগাগোড়া যেখান থেকে খুশী পড়া যায় , কবিতার ভাষা এই কবিতার দেহ । অঙ্গে প্রত্যঙ্গে লেগে থাকে তার ছোঁয়া ।

ছটি পর্বে, গ্রন্থখানি সাজ্জিত, নামকরণ গুলি নিজেই একটা কবিতা । পিছন থেকে 'তমার গানগুলি', 'প্রার্থিত পুনর্জন্ম', 'ড্রাগন ব্রিজ', 'একগুচ্ছ ভিলানেল','ঈষৎ রঙিন' ও 'রেনেসাঁস' । বলতে কী , আমি ভিলানেলগুলি আগে পড়লাম, আশ্চার্য কবিতা । এর শিল্পদক্ষতা অন্যরকমের । কাঠামো গত কবিতা যেমন কঠিন , তেমন তার সঙ্গে সেটা কবিতার মর্ম দেওয়া, খুবই কঠিন । আজকের কবিরা তা হয়তো করে উঠতে পারেন না । 

রূপ( form) কবিতার সঙ্গে যদি আবার মিশিয়ে দেওয়া মূল ( core), একটা বৃক্ষ ফুটে ওঠে । সেখান থেকেই আমরা একটা কাঠামো ধরতে করতে পারি, রিপিটেটিভ, তবে তার মজাই আলাদা । ভিলানেল নিয়ে কবি নিজেই বলছেনঃ

"তবুও তো আলো হবো, কোন এক নিষিদ্ধ শহরে

সব জেনে সব জেনে এ রাতে কেন যে ভুল করি

ভীত ভিলানেলগুলি সারারাত আর্তনাদ করে

মৃত ভিলানেলগুলি জেগে থাকে রক্তের শহর । "


কবিতাগুলি, কাঠামোর বাইরেও কবিতা হিসাবে বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে যায় । 


এক একটি মুখবন্ধ থাকে, একটি কবিতা পর্বের আগে । এটা জানি না প্রকাশকের কারসাজি কিনা, কিন্তু একটু কাব্যছোঁয়া হিন্টস , আরো একটু সিস্টেমেটিক হয়ে ওঠা । আধুনিক কবিতা পড়তে এসে এই কবিতার ভিতর যখন আমি জীবনানন্দের ভাষা বারবার আবিষ্কার করছিলাম, আমার মনে হচ্ছিল কিছুটা নস্টালজিয়ার ভিতরে আছি । ড্রাগনব্রিজ পড়তে পড়তে আবার মনে হচ্ছিল দক্ষিন আমেরিকার কবিতার কথা । জীবনানন্দ থেকে আরামসে ব্ল্যাঙ্কোর কবিতায় ভ্রমণ করা যায় ।  ঘটনাময় শিল্পআঁচড ও স্মৃতিমেদুরতা , বাংলা ভাষার সামনে একটা বিষণ্ণঘেরা শব্দচয়নের হাতছানি। কবি, সেটাকে পূর্ণ ব্যাবহার করেছেন । অনেক কবিতা, তবে সমস্তই একবারে পড়ে ফেলা যায় । কারণ তার বৈচিত্রময়তা । শেষ দিকে এসে একটা অদ্ভুত সুন্দর সিরিজ কবিতা । 


।। তমার গানগুলি ।।  কবিতাগুলো অচেনা শব্দকল্প দৃশ্যের অপার । বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে যায় । এই সেই থিম যার শিকড় এই গঙ্গা ভাগীরথী পদ্মা থেকে অনেক দূরে । একটা পরিশীলন ও দেখা একটি বিদেশী চোখে । সমুদ্র, বালি, চাঁদ, মৃত্যু, পশু, বন্যভূমি, স্প্রুস, ঝরনা, গুল্ম ইত্যাদি। এই ভাষা আমার অচেনা, খানিকটা চোখে দেখা টেক্সাসের তৃণভূমির কথা মনে পড়ে । আমি, বুঝি এই কবিতার ভিতরে ও বাহিরে এক অন্য জগত । সেই নিমগ্ন রাতটির কথা আমার মনে পড়ে, একা এক হেমন্তের রাত 'রাউন্ড রক, অস্টিন' থেকে হেঁটে ফিরছি ওরার্ণার র‍্যাঞ্চ , চারিদিকে জোতস্নার আলো । কি একটা সূর্যমুখীর গন্ধ ভেসে আসে । কি ফুল হবে ? খানিকটা ম্যাজেন্টা । কোথাও যেন আস্তাবল আছে । কিংবা ছিলও । একটা ঘোড়া যেন ডেকে উঠলো কোথাও । শেষ করা আগে, 'তমার গানগুলি' থেকে একটি কবিতা পড়া যাকঃ


"এক বিচিত্র রমণির সন্তান ঘুমিয়ে ছিলও তমার বাহুতে

স্তব্ধ বাতাস , স্তব্ধ বনবীথি, সবকিছু শুনশান স্তব্ধ

তখন হঠাত স্প্রুস গাছগুলোর পেছন থেকে জ্বলে উঠলো একটা তারা

পুড়তে লাগলো

তারাটি কথা বলেনি , শুধু তমার চুলে রেখে গেছে একটা সোনালি আভা । "


ধন্যবাদ কবি, নিরুপম চক্রবর্তী , আপনার এমন কিছু অনন্যসুন্দর কবিতা পড়ানোর জন্য , না পড়লে,  অনেক কিছুই জানা হতো না, পড়া হতো না আপনাকেও । ধন্যবাদ প্রকাশক সৃষ্টিসুখ, কর্ণধার রোহন কুদ্দুস যিনি, আমাকে গ্রন্থটি প্রেরণ করার আগেও জানতে চেয়েছেন আমি 'দিল্লিতে' বাড়িতে থাকবো কিনা, কারন উনি খোঁজ করে জানতে পেরেছিলেন, আমি মাতৃবিয়োগে বহিরগাছি, নদীয়া আমার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম । ধন্যবাদ, সমগ্র প্রচেষ্টাকে ।  গ্রন্থটি অধিক পঠিত হোক, কবি পাক তার প্রকৃত সম্মাননা,  এই কামনা করি ।



পীযূষকান্তি বিশ্বাস 

১২ ডিসেম্বর

মহাবীর এনক্লেভ

নতুন দিল্লি


  


 


  

 



 


Sunday, May 20, 2018

পাঠকামি-২৫ জ্ঞানেন্দ্রগীতি


পাঠকামির অনেক সংখ্যা হল - গদ্য পদ্য প্রবন্ধ । রক্ত, মজ্জায়, ধমনিতে যে পাঠ দশক দশক ধরে জমা আছে, তা লেখা হয় নাই । পাঠ আসলে একটা ক্রমাগত যাপনপদ্ধতি, যার কোন ঊষা নেই, যার কোন অন্তিম নেই । এই বয়ে যাওয়া মুহূর্ত,  এই এতটুকু সময়ের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে যা কিছু পাঠ্য , আমি যাকে পাঠকামি বলি, আর তা কেবল নিজের শিল্পবোধ, মনন, দেখে,  শুনে,  বুঝে, ও ঠেকে শেখা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই । নিজেকে উলটে দিই,  পাঠ্যকে ঋজু করি,  বোঝাপড়া, টানাপড়েন, গদ্য, পদ্য, অন্ত্যমিল নিয়ে আমি যা কিছু বুঝি । নিয়মিত-অনিয়মিত অনেক বই পড়ে থাকি , আজ পড়ছি একটা বিশেষ গ্রন্থ , নামঃজ্ঞানেন্দ্রগীতি । জ্ঞানেন্দ্রনাথ বিশ্বাস আমার স্বর্গীয় পিতা,  তার অল্পকিছু গান সংকলিত হয়ে এই বইটি উবুদশ পাবলিকেশনের থেকে বের হয়েছিলো ২০০৭ সালে, যার সম্পাদনা করেছিলেন আমার জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতা পলাশকান্তি বিশ্বাস । আজ কিছু সেই পাঠের অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু বলি ।
জ্ঞানেন্দ্র-গীতিঃ সংকলন ও সম্পাদনা-পলাশকান্তি বিশ্বাস ।
তখন, কত ছোট মনে নেই, বাবা নিজের টুমটুমি বাজিয়ে গান করছেন “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি” । টুমটুমি মানে একতারা,  আর বাবা নিজেই বাজান বায়া । পায়ে কখনো ঘুঙুর বাঁধেন, কখনো নয় । দরিদ্র সংসার, সমস্ত দিনের শেষে এক প্রস্থ আঙিনা, চাঁদের আলোয় গান করছেন বাবা জ্ঞানেন্দ্রনাথ বিশ্বাস । গানের কথা, কখনো লালন ফকির, কখনো দুদ্দু শাহ, কখনো বা নিজের লেখা। বাবা গান করতেন ভাবগান, লিখতেন দেহতত্ত্বের গান। এইসমস্ত গান, গ্রামের দিকে জনপ্রিয় হলেও সমগ্রসাহিত্য মঞ্চে দেহতত্ত্বের গান নিয়ে বাংলা সাহিত্যে উৎসাহী পাঠকের স্বল্পতা নজরে আসে । পাঠকের আগ্রহ কম । লোকসংগীত বা পল্লিগীতি যেহেতু পল্লির গান, আর ব্যবসা বাণিজ্য যেহেতু নাগরিক সভ্যতার মাপকাঠি, সেখানে শহুরে ভাষা, পাশ্চাত্য সাহিত্য, মার্জিত ভদ্র ও সাংস্কৃতিক র‍্যাপার চড়ে বাংলা সাহিত্য বাজার একচেটিয়া অধিকার হয়ে আছে। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ইউরোপে প্রথম ‘ফোক’ বলে প্রচারিত হয় গ্রামের নিরক্ষর, পশ্চাৎপদ কৃষকদের কুসংস্কার পূর্ণ প্রগতি বিরোধী প্রাক-শিল্পবিজ্ঞান-প্রগতি যুগের সংস্কৃতি হিসাবে । কিন্তু এই পোড়া বঙ্গপ্রদেশে তবুও দেখি সেই ভাঙা চালের খরিদ্দার আজও শেষ হয়ে যায়নি,
বরং দেখি কাতারে কাতারে মানুষ গ্রামে গঞ্জে হাটতলায় এখনো বিজয় সরকার, অসীম সরকার, অশ্বিনী গোঁসাইের গানে মাতোয়ারা । এই পল্লিগীতি, ভাবগান, হরিসংগীত যারা করে আর এই গান যারা শ্রবণে আত্মহারা হয়, তারাই বীজ বোনে, পাকা ধান কাটে, নৌকা চালায় । কষ্টে তাদের দিন কাটে । আমার পিতা ছিলেন তাদেরই একজন, তাদেরই গায়ক, সাধক, গীতিকার, সুরকার । বাবাকে পাঁচ গ্রামের সবাই গোঁসাই বলতেন । বাবা,  প্রধানত লালন গীতি গাইতেন । প্রশ্নোত্তরের খাতা ছিল বাবার ।কঠিন প্রশ্নের কঠিন জবাব । সব গানে । হরিসঙ্গীতের অনুষ্ঠান, মহৌতসবে, সাধুগোষ্ঠে যেতেন । বাবা শেষ বয়সে একতারা ও বায়ায় রবীন্দ্রসঙ্গীতও গেয়েছেন । এই সমূহ বাদ্যযন্ত্র দিয়ে যে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া বিধিসম্মত নয়, বাবুদের গোসা হয় । তা বাবা জানতেন না ।  আমি আজ বুঝি । আর বুঝি আমার জানার বোধের পরিধি কত সীমিত । আর এই বাংলা বাজারে আমিই বা কে ? এই হাতে, কলমে, বই, ধমনী বয়ে চলেছে যে গ্রাম্য-জীবনপ্রবাহ,  জ্ঞানেন্দ্রগীতি থেকে একটা গান নিয়ে সেই কথা বলিঃ
“অন্ধকারে বন্ধঘরে ডেকে কারো পাইনা সাড়া ।
আমি দিশেহারা জন্মঅন্ধ দিচ্ছি কতো কড়া নাড়া ।।
নয় দরজায় একজন দ্বারী
ঘরখানা ভূতের কাছারী
চিনি না মন তুমি কোনজন আমিই কেবা বাইরে খাড়া ।।

সংসার পথ পিছল অতি
তায় চলিবার নাই শকতি
ঝঞ্ঝা জঞ্ঝাটে দিবানিশি কাটে , পাইনা কভু পথের দাড়া ।।

গুরুকৃপা হয় না যাহার
কৃষ্ণকৃপায় কি করে তার
অজিতচাঁদের চরণ ভুলেরে মন জ্ঞানা হল হতচ্ছাড়া ।। ”
[গান নংঃ ২ – পাতা ২৩]

গান, গুরু-শিষ্য পরম্পরার । নিজেকে চেনার, নিজের অবস্থান বিচার-বিবেচনার । চেনার নানান রকমফের আছে । জানারও আছে নানান সিনট্যাক্স । খোঁজ থাকে চিরায়ত । শিক্ষাগুরু, দীক্ষাগুরু । গুরুর কৃপায় শিষ্য দর্শন করেন নিজের অবস্থান । সাহিত্য সৃষ্টির আদিযুগ থেকে চলছে আইডেন্টিটি প্রতিস্থাপনের প্রস্তাবনা । অর্থ যশ খ্যাতি খাদ্য বস্ত্র নিয়ে নানান প্রকারের লড়াই, সংগ্রামের ইতিহাস । লালন সাই বলেছেন- “আপন ঘরের খবর লে না / অনায়াসে দেখতে পাবি / কোন খানে সাঁইর বারামখানা ” বা  “আমি একদিন ও না দেখিলাম তারে/ বাড়ীর কাছে আরশি নগর/ এক পড়শি বসত করে”  । নিজেকে নিয়ে উন্মোচনের শেষ নেই, নিজেকে নিজের সামনে দাঁড়িয়ে যে কোন কবি খুঁজে পেতে চায় অস্তিত্ব আর নিজের জিজ্ঞাসায় সে এক বিপন্ন বিস্ময় । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখলেন , “আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ, এই কি মানুষজন্ম ? ” । পল্লি বাংলার চেনার পদ্ধতি আর আধুনিক পাশ্চাত্যের আধুনিকতার খোঁজ কি আলাদা, নাকি শব্দ আলাদা, নাকি বোধ? কবিতা কি জল মাটি আবহাওয়ায় আলাদা হয়ে যায় ? আর একটা গান নিয়ে বলি ?

“আগে জানো মন সেই প্রেমের পরিচয়
প্রেমের সন্ধি জেনে শুদ্ধ রসিক জনে 
            অমৃত ভজনে নির্বিকার হৃদয়।।
মদন মাদন শোষণ মোহন উন্মাদে
প্রেমের জন্ম যে প্রেম কৃষ্ণকে আহ্লাদে ।
মদন বাম নয়নে , মাদন দক্ষিণ কোণে এ দুইয়ের মিশ্রণে শুভ মিলন হয় ।।”
[ গান নংঃ ১২ – পাতা ২৯]

শুদ্ধ প্রেমের এহেন বিশ্লেষণ ও তাকে সংজ্ঞায় বেঁধে ফেলতে চাওয়া, এ এক জটিল দেহতত্ত্বের অবতারণা । একজন বৈষ্ণব , একজন বাউল, একজন সাধকই সেই বাঁধনের গাঁট জানেন । মদন, মাদন, নয়ে নয়ে এই ধ্বনিময়তার এক দারুণ আবেশ আছে ।  তেমন সাংকেতিক সন্ধ্যার এমন ভাষা প্রেমের এহেন গভীরতম প্রদেশে যাওয়ার জন্য এমন ভাবপ্রবাহ তৈরি করে , তা বোধহয় সঠিকভাবে ধরতে গেলে আপনাকে সশরীরে একদিন উপস্থিত থাকতে এমনই কোন বাউল আখড়ায় । আমিও বাবার সাথে বেশ কিছু আসরে থেকেছি । গান শুনেছি, খানিক বুঝিনি, খানিক ভুলে গেছি । মনে পড়ে,  বাবা নিজে গান গাইতেন, লিড করতেন, দোহার দেওয়ার জন্য আরও গায়কেরা মজুত থাকতেন । গ্রাম্য পরিবেশ, দিনক্ষণ মিডিয়া মাইক ছাড়াই আসর বসতো কারো বাড়ির বারান্দায়, মন্দিরে, হাটতলায়। জমে উঠত গানের লড়াই । গান করে কঠিন প্রশ্নের মুখে গুরুকে দাঁড় করিয়ে দিতেন । জটিল সেই বিষয়, দেহের গঠন, মানুষ জীবন, মানুষ যাপন, গূঢ় তত্ত্বের মধ্যে লুকিয়ে থাকতো জন্মমৃত্যুর সওয়াল, আটকুঠুরি আর আঠারো মকামের রহস্যরাজি । জ্ঞানেন্দ্রগীতি থেকে আর একটা গান দেখি ।
“আগে গুরু জান, পাবি তার সন্ধান, মনের মানুষ বর্তমান, খেলছে দ্বিদলে
তার জন্ম মৃত্যু নাই শক্তিতে উদয়, দৃশ্য হবে তাই চক্র ভেদ হলে ।।
চতুর্দল পদ্ম চারিটি অক্ষরে
গুহামূলে দেখ চক্র মূলাধারে
ছয় অক্ষের নির্মাণ চক্র স্বাধিষ্ঠান ষড়দল পদ্ম আছে লিঙ্গমূলে ।

দশ অক্ষরে আছে নাভিমূলে স্থিতি
মণিপুর চক্র তথায় বসতি
দ্বাদশ অক্ষরে গঠিত চক্র অনাহত, সে পদ্ম বিরাজিত হৃদি-দলে ।

আছয়ে বিশুদ্ধ চক্র কন্ঠমূলে
ষোড়শ দলের গঠন ষোল অক্ষর মিলে
ভ্রূদ্বয়ের মাঝে সে যে দু অক্ষরে শুক্ল বর্ণ পদ্ম-দলে ।

দেহ ষটচক্র হলে নিরূপণ
কালের চক্র ফিরে যাবে অকারণ
বলে জ্ঞানদাস বিষ্ণু চক্রে এসে লয়ে যাবে তারে গোলক মণ্ডলে ।” 
[গান নংঃ১৩ --পাতা ২৯]

মনের মানুষ খোঁজা একটা প্যারাডক্স । তাকে দেখা-পাওয়া একটা জার্নি । কিরকম সেই যাত্রা ? কতদিন লাগে ? এতো জিজ্ঞাসা থাকলে, গুরুর কাছে যেতে হবে । গুরুর কথা জানতে আপনাকে যেতে হবে সাধুগোষ্ঠে । শুনতে হবে গুরু আর শিষ্যের গানের আজব লড়াই । কোথায় তার ভেদাভেদ,  কে গুরু কে শিষ্য যা ব্যাকরণ দিয়ে বেঁধে ফেলা যায় না । চলুন বাংলার যে কোন গ্রামে । সবুজ ধানের ক্ষেতের পাশে যেখানে মাটির উঠানে বসেছে তত্ত্বকথার আসর,  রসিকজনের মাঝে গান শোনাচ্ছেন কোন গোঁসাই । জ্যোৎস্নায় ভরে যাচ্ছে ধানের মাঠ । ক্ষেতে সারাদিন শ্রম দেবার পর ক্লান্ত হয়ে আসা চাষা, দিনমজুর কি গান শুনতে চায় ? চিত্রসঙ্গীত, গণসঙ্গীত নাকি ব্যান্ডের গান ? নাকি হিপহপ না র‍্যাপ নাকি ললিত রাগের এগারোতাল ? এই এতকাল ধরেও গ্রামে বরং চলেছে সেই পল্লিগীতির প্রবাহ, এখনো সেই বৃন্দাবনে বাঁশী বাজেরে, কালার বাঁশীর সুরে সুরে ময়ূর নাচে রে । জ্ঞানেন্দ্রগীতি থেকে আর একটি গান নিচ্ছি ।   
“ইটে বাঁধা ভিটেমাটি কি সুন্দর কি পরিপাটি, দেহটি সুরম্য রংমহল।
সে যে কোন কারিগর গড়েছে ঘর দুই খুঁটির পর কলকৌশল
সপ্ততালা রংমহলা দুই বাতি করছে ঝলমল

আট কুঠরি আঠারো মোকাম, মহাজনের সোনার পুরী অটবী তার নাম
রিপু ইন্দ্রিয়গণ করে সংগ্রাম হীন হইলে বুদ্ধিবল
কামিনী কাঞ্চনে ভুলে সমূলে নির্মূল হয় সকল ”
[গান নংঃ ২৮ --পাতা-৩৭ ]

দেহতত্ত্বের গান মানে, মানে দেহের অঙ্গ, তার জন্ম, গঠন, পরিণতি । একা ঈশ্বর সমস্ত জন্মমৃতুর অধিকারী নয়, বরং পিতা মাতার মিলন, আর মিলনের বিভিন্ন সময় ও ধাপের পরে নির্ভর করে মানবজীবন । আটটি ছিদ্র মানব শরীরে । পিতার চার মোকাম, মাতার চার মোকাম, মহাজনের দেওয়া দশ মোকাম । আঠারো মোকাম নিয়ে মানবশরীর । ভাগ্য বা কপাল বলে কিছু স্বীকার করে না দেহতত্ত্ব । মনে হয়  খানিকটা সংস্কৃতির বাইরের । খানিকটা তথাগত বিশ্বাসের বাইরে । তাই অনেকেই অপসংস্কৃতির ধুয়া টানেন । কোন ফরমুলা,  সভ্য সংজ্ঞায় বাঁধা যায় বা । সাহিত্য প্রদর্শিত পথেও চলতে চায় না, ছন্দে, ভাষায়, অন্ত্যমিলে, আচার বিচার বিশ্বাসে এই সমস্ত গানে অসঙ্গতি থাকে । মানব দেহ, আর তার বিকাশ নিয়ে এক অদ্ভুত বিষয়, জন্ম মৃত্যুকে অন্য মাত্রায় লিখে ফেলেন পদকর্তারা । নিজেরাই গান, গানের তাল, রাগ, লয় ঠিক মিলিয়ে নেন । এই মতবাদগুলি যেহেতু কোন সাহিত্য আন্দোলন ম্যানুফেস্ট নয়, কোন শাস্ত্রতে আবদ্ধ নেই, কোন ধর্ম মানে না, কোন গীতা কোরান নেই । আট কুঠরি নয় দরজায় ঘুরে ফিরে আসছে এই গানের সুর । সেই সুরের তাল ধরা তাই এত সহজ ? কোন বস্তুবাদী চাওয়া পাওয়া, বিক্রিবাটা, প্রকাশন, টি আর পি, ফেসবুক,
হোয়াটস অ্যাপ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না । কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বলে তা বহুদূর, মানুষেরই মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতেই সুরাসুর । গানের আসরে উপস্থিত হলে ধনী গরীব হিন্দু মুসলিম বলে কিছু থাকে না । আমি নিজের চোখে দেখেছি, বাবা গুরু সেজেছেন, এক মুসলিম ভাবগান শিল্পী প্রশ্নকারী হিসাবে কৃষ্ণের ভূমিকায় গান করেছেন । আর তার জ্ঞানের সীমা দেখে চমৎকৃত হয়েছেন তাবড় তাবড় গোঁসাইগণ । এইসব আসরে যারা শিল্পী, শ্রোতা, আয়োজক উপস্থিত থাকেন, তাদের বেশীর ভাগ মানুষের মিডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ নেই, তাদের ইউরোপীয় সাহিত্য নিয়ে আন্দাজ নেই, রবিঠাকুরের আলোর তীব্রতা সম্পর্কে ধারণা নেই, তার বুঁদ হয়ে শ্রবণ করে মেঠো সুর আর আপন ইশারায় খুঁজতে থাকে অধরা সেই মনের মানুষ । জ্ঞানেন্দ্রগীতি থেকে আর একটা গান নিচ্ছি ।
“ও মন বুঝলি না রে, ও মন খুঁজলি নারে
ঘর বেঁধে সে ঘরের মালিক রয়েছে ঘরে
গুরুকৃপা বিনে পাবি কেনে অরণ্যেতে ঘুরে ।।

আট কুঠরি নয় দরজা আঠারো মোকাম
চুরাশি অঙ্গুলি সে ঘর এইতো দেহধাম
ছন্দে-বন্দে কত জোড়া
দুই খুঁটির পর আছে খাড়া
সুষুম্না পিঙ্গলা ইড়া বাঁধা তিন তারে ।

পঞ্চভূত আর পঁচিশ তত্ত্বে এ ঘরের গঠন
রুয়োর জোড়া হাড় পাঁজড়া আঠন আর ছাটন
উপর তলায় বাতি জ্বলে
নীচের তলায় গঙ্গা খেলে
মন-মনুরায় মধ্যস্থলে বসত করে রে ।

জ্ঞানদাস কয়, হংসরূপে ঘরখানি খাড়া
পাখি যেদিন উড়ে যাবে ভাঙবে রে আড়া
সাধুসঙ্গ লাগিয়ে প্যালা
বসে থাকো সকল বেলা
জপো হরির নামের মালা শমন যাক ফিরে । ”
[গান নংঃ ৪৯ –পাতা ৪৯ ]

বাউল ঘরানার গানগুলোতে আঠার মোকাম কথাটা বারবার আসে । দেহ এক মন্দির । আর এইখানেই সমস্ত গয়া, কাশী, বৃন্দাবন, মথুরা, মক্কা মদিনা এক হয়ে যায় । প্রতিটা অন্তরায় পদকর্তার নাম রাখা প্রাচীন বাংলার সাহিত্য প্যাটার্নের মধ্যে পড়ে । বাবা যেহেতু লালন ফকির কে মনে মনে দ্রোণাচার্য ভাবতেন, তাই লালনের গানগুলির থেকে সংগ্রহ করেছেন অনেক শব্দ, ভাবনা, তত্ত্ব আর নিজের অভিজ্ঞতা মিশিয়ে করে লিখেছেন জ্ঞানেন্দ্রগীতি । বাবা দেহতত্ত্বের গান ছাড়াও ভক্তিগীতি, প্যারোডি, হরিসঙ্গীত, প্রশ্নোত্তরের জন্য পুরাণ, ভাগবত, মহাভারত, উপনিষদ , হাদিস ঘেঁটে গান লিখতেন । যে কোন গানের আসরে, যে কোন বাদ্য বাজিয়ে উক্ত আসরে নিজের উপস্থিতিকে অপরিহার্য করে তুলতেন । বাজাতেন বাঁশী, বেহালা, দোতারা, একতারা, বায়া, তবলা, করতাল, ঘুঙুর, প্রেমজোড়ি ইত্যাদি । বয়স, লিঙ্গ, ধর্মকে পিছনের সারিতে রেখে উৎসাহ দিতেন প্রকৃত শিল্পীদের । ভালো বেহালা বাজাতেন আমার ছোট কাকা নিত্যানন্দ গোস্বামী । কাকা নিজেই ছিলেন মস্ত বড় ভেকধারী বৈষ্ণব ঘরানার গোঁসাই । তার অনেক শিষ্য এখনও বর্তমান । কাকার আশ্রম ছিল পায়রাডাঙ্গায় । বাবার সঙ্গে ঐ আশ্রমে আমি বেশ কয়েকবার গেছি ।
কাকা বাবার থেকে বয়সে ছোট হলেও, তাকে গুরুজ্ঞানে এমন শ্রদ্ধা করতেন,  মনে হতো যেন কাকাই জ্যৈষ্ঠ । কাকার শিষ্যদের মধ্যে বাবা লেখা গান আজও সমান সম্মানের সাথে গাওয়া হয়। রস আস্বাদনে বাবা অনেক সম্প্রদায়ের মধ্যেই পরিচিত ছিলেন, গান বাঁধতেন উপযুক্ত । গানে সাংকেতিক ও সন্ধ্যাভাষার ব্যবহার ছিল করতেন স্বচ্ছন্দে । একটা গান নিয়ে আলোচনা করি ।
“বাঁকা নদীর পিছল ঘাটে ডুব দিবি তুই কেমন করে
পূর্বতনে পূর্বতনে
কালো কুম্ভীরিনী ঘোলাজলে রয়েছে বদন ব্যদনে
পূর্বতনে পূর্বতনে।।
তিন নদীর এক মোহনা, ডুবেছে রসিক জনা
অরসিক স্থান পাবে না সেই যে ক্রীড়াঙ্গনে ।
যত লোভী কামী, কর্মী জ্ঞানী হারা হল পিতৃ-ধনে
– পূর্বতনে পূর্বতনে ।
ত্রিবেণীর তিনটি ধারে, যেজন স্নান করতে পারে
মহাভাব সফল কর্ম সফল শ্যামপট্ট শাড়ি ধারণে
- পূর্বতনে পূর্বতনে ।
সাধকের সাধনতত্ত্ব, কৃষ্ণের বিলাস মাহাত্ম্য
যেজন জেনেছে সত্য রামানন্দ স্থানে ।
অধম জ্ঞানদাস কয়, সেই চৈতন্য মান্য এ ভবের ভুবনে
- পূর্বতনে পূর্বতনে”
[গান নংঃ ১২৭—পাতা-৯৩]

সাহিত্যবোধ, তত্ত্বকথা, দেহরহস্য, নাস্তিকতা, গ্রাম্য সংস্কৃতি নানান প্রবাহের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি আমরা । শিল্পের নানান ধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি আবার এসে মিশে যাচ্ছি বঙ্গপ্রদেশের জনধারায় । কেউ বলছেন আবহমান, কেউ পুনরাধুনিক, কেউ বা মেটামর্ডান , কেউ বা শুধুই গিমিক । ফর্ম আসছে, ভেঙে যাচ্ছে, আমরা বলছি এটাই সাহিত্যের উচ্চতা, এটাই শিল্পের দৈর্ঘ্য, এইটাই কবিতার প্রস্থ । নানান সাহিত্য আন্দোলনগুলি দেখলে বোঝা যাচ্ছে, এই দেহতত্ত্বের আবেদন, ভাবসংগীত, বাউল নিয়ে কোন উচ্চধারণা মানুষের মধ্যে নেই । তথাকথিত ইলাইট ক্লাস পাশ্চাত্য সাহিত্য নিয়ে বরং অনেক কালচার করছেন, প্রচলিত ধারণার বাইরে যে নিজস্ব বঙ্গ শিল্প সাহিত্যকে আমল দেন নি । বরং ‘ফোক’ বা ‘লোকসংগীত’ বলে আমাদের এই দেশীয় সাহিত্য প্রচেষ্টাকে ভাগাড়ে ফেলে দেওয়ার প্রয়াস দেখি । যারা ‘ফোক’ মানে গ্লামার গ্লামার বোধ করেন, এক কথায় তাদের জানিয়ে দিই, এটাকে আলোকিত কবি সাহিত্যিকরা নিকৃষ্ট মানের সাহিত্য বোঝাতেই ব্যবহার করে থাকেন । অর্থাৎ লোকসাহিত্য হল চাষাভুষা, অশিক্ষিত এক গ্রাম্য সাহিত্য বিশেষ , যা একটা অপসংস্কৃতি । অথচ লালন চলে গেছেন আজ দুই শতাব্দী, দুদ্দু শাহ চলে গেছেন এক শতাব্দী, গ্রামে গ্রামে তাদের উত্তরাধিকারীরা, তাদের জিন গায়ে, ব্যাধি গায়ে , সেই একই রোগ বংশপরম্পরায় আমরা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে । অথচ আমি নিজেই গান শিখিনি, গাইতেও জানি না । বাবা বলতেন, “গান আমাকে কিছু দিলো না, তোরা কেউ গান শিখিস না, পড়াশোনা করে ভাল একটা চাকরি কর, বাড়ি কর, গাড়ি কর” । একজন প্রকৃত শিল্পীর কাছে এ হল এক অভিমান, এমন বঞ্চনার কাহিনীথেকেই শিল্পীজীবন বোধহয় সৃষ্টির রসদ খুঁজে পান ? মানুষ থেকে শিল্পী আলাদা হয়ে যান ।  যেকোনো শিল্পীকেই চেনা অসম্ভব হয়ে পড়ে,  তা পুত্রের কাছে নিজের পিতাই কেন না হন । তাঁর একটা ভিন্ন স্বাদের গান পড়ি ।

“বাংলাদেশের জংলা ব্যাধি হয় না আরাম
ব্যাধি দিনে ভালো রাত্রে বাড়ে যোগেতে ফেরে বারাম ।।

ব্যাধি আগে ছিলো ঠাকুর দাদার
তার পরে হইলো বাবার
এখন দেখি ঘটলো আমার – এ তো বংশগত ব্যারাম ।।

মনে করি সারবে এ রোগ
ঘরে বাইরে হয়ে এক যোগ
যোগ হইলে ঘটে দুর্ভোগ , এর চেয়ে কি আছে হারাম ।।

রোগ হয়েছে বারোমেসে
কই বা কারে সারে কিসে !
বলে অধম জ্ঞানদাসে, খেদে নয়ন ঝরে অবিরাম ।।”
       
[গান নংঃ১২৫—পাতা-৯২]

এই লেখাগুলি মধ্যে অনেক ছন্দের ঘাটতি, পঙক্তিগুলি অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্তের ধার ধারে না । পুরাতন শব্দের চয়ন, গুরুচণ্ডালীর দোষ, অন্ত্যমিলের নানান সমস্যা বিদ্যমান । বর্তমান যুগের সঙ্গে বেমানান আর সাহিত্য মূল্য হিসাবে যা নিম্নপর্যায়ে পড়ে । এটাই মোড়ক, এটা বিক্রি হয়, এটাই অনুপস্থিত । আর নিঃসন্দেহে বলা যায় যে কোন গ্রাম্য গোঁসাই, ফকির, বাউলের পদে এই সমস্যাগুলি বর্তমান । আধুনিক আর অত্যাধুনিক বাংলা সাহিত্য নিয়ে যে সমস্ত গদ্য পদ্য আর কবিতাবোধ নিয়ে কথা হয় তার মধ্যে ভাবগান, বাউল , শব্দগান, সাধু গান, ধুয়া, মুর্শিদি, মারফতি, পাল্লা/প্রশ্নোত্তরি, ফকিরি, কীর্তন পড়ে না । আমরা আধুনিক মানে হতে চেয়েছি পশ্চিমমুখী,  প্রাচীর ওপারে আমাদের প্রবল উৎসাহ, কিন্তু বাংলার নিজস্ব সাহিত্যকে কোন মঙ্গল কামনা ছাড়া আর কি বা করতে পেরেছি, না লিখেছি নিজের কাহিনী , না লিখেছি নিজস্ব কাব্য । দাড়ি, কমা সেমিকোলন সহ, আজও আমরা মোবাইল, কম্পিউটারের গভীরে পাশ্চাত্য ধারা নিয়ে এত বেশী ঢুকে পড়েছি, তার আসল রূপ সরাসরি সাহিত্যের নাগরিক জীবন আর বিক্রিয় ক্ষমতার উপর দাঁড়িয়ে আছে । অর্থাৎ পিজ্জা বার্গার বিক্রয়মূল্য চাল আটার কয়েকশতগুণ অধিক , কিন্তু হিসাব করলে দেখলে দেখা যাবে চাল আটার জন্য ধান গম যবের উৎপাদনকারীরা সেই গ্রাম্য কৃষক, জনমজুর, গাড়োয়াল । জ্ঞানেন্দ্রগীতি থেকে আর একটা গান নিচ্ছি । 
“ঘর গুঁতিয়ে ভাঙ্গলি কেন যে ঘরে তোর উপাসনা
বানাতে যে নেই খমতা ভাঙ্গতে কেন হয় বাসনা ।।
ভালো একটা মুগুর পেয়েছ, মাথায় ফ্যাটা বেঁধেছ
হেঁইও হেঁইও করে তুমি সজোরে ঘাই দিতেছো
তোমার চিরদিন যাবে না সমান, চুপটি করে বোসো না ।।

গুরু যে নাম দিল তোর কানে, একবার ভেবে দেখলি নে
নামের স্বরূপ রাধাকৃষ্ণ তাই শাস্ত্র বাখানে
আশ্রয় গুরু সখী জ্ঞানে কেন তারে ভালোবাসো না ।

দুই খুঁটির পর ঘর খাড়া আছে অনন্ত জোড়া
ছাউনি তাহার উলুখড়ে চামড়াই বেড়া
কত মণিমুক্তা আছে ভরা ( জ্ঞানা কয় ) চিনলি না মন রসনা ”
[গান নংঃ ১৭৯ –পাতা ১২৪]
 
এখন বিচার বিশ্লেষণ করে যা দেখতে পাচ্ছি,  এইসমস্ত জীবন, যাপন নিয়ে খুব মর্মাহত পদকর্তা । যে রেসিপি বা ইনগ্রিডিয়েন্টসগুলি দিয়ে উত্তম পাকের ব্যবস্থা করা হয়, আর যে মশলাগুলির ব্যবহার নিয়ে স্টার সিস্টেমের জন্ম । তবু কোন খাদ্য দিয়েই সেই রসনা তৃপ্ত হয় না । ‘বোধ’ কবিতায় জীবনানন্দ বলেছেন “শরীরের স্বাদ কে বুঝিতে চায় আর? প্রাণের আহ্লাদ সকল লোকের মতো কে পাবে আবার! সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর স্বাদ কই!” । এইতো হল কবিতা । সাহিত্যে শিক্ষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে ভ্যালু সিস্টেমের র‍্যাপার গায়ে চড়ে যায় আর সেখানে প্রান্তিক বাংলা সাহিত্যকে লালন করা যায় নাই ।  পয়ারশ্রেনী কবিতাকে আপনি অমৃতাক্ষর নিয়ে পুনর্বাসন তো দিলেন, শব্দ, সিনট্যাক্স, ধ্বনি, মেটাফর দিয়ে সমহিত তো করলেন, শিল্পী মানুষের ভাবনায় তাতে রকেটগতি এনে দিলো ? আধুনিকতার মোড়কে এখনো পশ্চিমী দুনিয়া আমাদের মোহিত করে রেখেছে । অথচ বাংলা বলতে এখনো একটা বৃহৎ গ্রাম, আর নদীকূলকুল গ্রামের ভিতরদিয়ে যখন বৈশাখের বাতাস খেলে যায়,  আমনের উস্কানিতে মেতে ওঠে মুর্শিদি, ভাটিয়ালি, সেই সুরতান তা আধুনিকতা দিয়ে বোধহয় ধরা যায় না । এর আলাদা উপলব্ধি, এহেন গ্রাম বাংলার কোন এক্স ফ্যাক্টর নেই, যা রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী আর জীবনানন্দের বনলতা দিয়ে পরিমাপ করা যায় । আমাদের চিন্তা মনন আর মৌলিক ভাবনার সমস্ত বীজ এখনো প্যাটেন্ট করা হয়নি, সে সুগন্ধি ভাটিফুল হোক আর ভুঁইচাপার সংক্রামক সবুজ । সুতরাং লালন ফকিরের মতো ‘আনপড়ের’ মতো বাংলা কবি পাঠের বাইরে থেকে গেলেন । কোন স্কুলের এনুয়াল ফাংশনে কেউ তার কবিতা পাঠ করলেন না,  কোন ছাব্বিশে বৈশাখে কোন ফিকির চাঁদ, দাশরথি রায়, দুদ্দু শাহ, হাসন রাজা, অশ্বিনী গোঁসাই, বিজয় সরকারের জন্ম জয়ন্তী পালন হল না । রবির দেশের এইতো মৎস্যন্যায়; রবির কিরণ এতই প্রকট যে, সাহিত্য ইকোসিস্টেমের প্রান্তিক গ্রাম্য চাষি, ফকির, বৈষ্ণব, যোগী, সাধু, গোঁসাইদের বিক্রয়যোগ্যতা যে এক্কেবারেই শূন্য, তা বলাই বাহুল্য । কত কথাই মনে পড়ে, কত অভিমান, কত বঞ্চনার কথা, শিল্পীর একা হয়ে যাবার কথা । বাবার আর একটা অন্য স্বাদের গান নিয়ে আর একটু বলার ইচ্ছে জাগে ।

“যাস নে কেউ ঢাকার শহরে, যাসনে কেউ ঢাকার শহরে
দেখে ঢাকার শোভা মনোলোভা, মুনির মনও হরণ করে ।।
শহরে আছে মজার কল
বেরুচ্ছে সাত রকমের জল
লবণ ইক্ষু সুরা সর্পী (দধি) দুগ্ধ জলন্তল ।
সে জল চেখে দেখে মহাসুখে সাধু জনা পান করে ।।
ঢাকাতে কুণ্ড আছে নয়
আটটিতে নেই কোন সংশয়
একটিতে তার অতল গভীর ব্রহ্মকুণ্ড কয় ।
যত মানুষ গরু করে হরণ রাখে ব্রহ্মা তার ভিতরে ।

ঢাকেশ্বরী আছে ঢাকাতে
চার আঙ্গুল খালি জায়গাতে
লোল রসনা এলোকেশী রয় খাড়া হাতে
তার জিহ্বাখানা লকলক করে রক্ত খাবার তরে ।।

সেখানে যেতে যদি চাও
আগে মাথাটি মোড়াও
কামনা বাসনা ছেড়ে খোদ বৈরাগী হও
অধম জ্ঞানদাস কয় মা মা বলে গমন করো ধীরে ধীরে । ”
[গান নংঃ১৭৮ -পাতা-১২৩]

গান কবিতায় সঠিক উপমা লাগানো একটা চ্যালেঞ্জ । তারপর একটা কাহিনী, বিষয় প্রাসঙ্গিকতা, গতি, ও পরিপূর্ণতা । এইসমস্ত নিয়ে আসরে, বাড়িতে তুমুল আলোচনা দেখেছি । বাবা ছিলেন কৃষ্ণভক্ত গৃহী বৈষ্ণব । গানের ধারা, সামাজিকতা, যুক্তি নিয়ে অনেক আলোচনা হতো, কখনো বুঝেছি, কখনো বুঝিনি । সংসারে থেকে এ আবার কেমন যোগী তার ধর্ম, কর্ম, ঠিকানা কিনারা করা কঠিন । বাউল হয়ে যাওয়া, মনের মানুষের খোঁজ কোন যুক্তি তর্কে লজিকে বেঁধে ফেলতে দেখিনি । বাউল সম্প্রদায়, সহজিয়া যাপনের বিস্তর তত্ত্বকথা রয়েছে । প্রচলিত আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক চর্যাচর্যের সঙ্গে লোক ধর্মের বিস্তর ব্যবধান রয়েছে । পুরুষতান্ত্রিক ব্যক্তি মালিকানা এবং অধিকারকে অর্থ বর্ণ জাতি লিঙ্গ সম্প্রদায় ভেদকে মানে না বাউল ফকির মতাদর্শ । সামাজিক সম্পর্ক এবং নীতি নৈতিকতা এই মতাদর্শে আলাদা । বৈদিক /শরিয়তি দৃষ্টিতে এই মতাদর্শ অনাচারী । আবার এদের দৃষ্টিতে বৈদিক বা শরিয়তি অপসংস্কৃতি । নরনারীর সম্পর্ক স্বতন্ত্র । এদের লিখিত শাস্ত্র, উপসানালয়, নির্দিষ্ট আচার নেই । হস্তলিখিত কড়চায় ও মৌখিক প্রবাহে এ দর্শন এবং সাধ্য সাধনা বয়ে চলেছে । গুরু বা মুর্শিদি ধরে এই ভাবাদর্শ ছড়িয়ে পড়ে । এদের কোন শাস্ত্র বা আচার বা উপসানালয় নাই । আছে সাধুসভা । গুরুশিষ্য পরম্পরা । গুরু মানে ভাববাদী তত্ত্ব নয়, অগ্রজ পথপ্রদর্শক । এরা পরলোক, জন্মান্তর, ধর্মাচার-ব্রত-উপবাসাদির বিরোধী, এই তত্ত্ব অনুযায়ী বাউল সম্প্রদায়রা নাস্তিক । জগত সৃষ্টির ব্যাখ্যার জন্য তারা ঈশ্বর কল্পনা অনর্থক মনে করেন । অনেক সাধক শক্তিপ্রবাহের অন্তঃস্থলে আকার সাকার নিরাকারের আড়ালে দেহে চেতনায় নির্ভুল ভাবে উপলব্ধি করেন চৈতন্যকে, জ্যোতির্ময় নবীর নুরকে । দেহের জন্ম উপাদান রজেঃবীজে তার নিশ্চিত অবস্থান চিহ্নিত করে ।

এতক্ষণ পাঠে এতোটা তো ক্লিয়ার যে ভাবগান-শব্দগান-দেহতত্তের গান, বাংলার অপরিহার্য একটা সাহিত্য ধারা ।সঠিক যোগাযোগ আর যথাযথ উপস্থাপন হলে, গ্রামবাংলার গান, বাংলার আপন হয়ে ওঠে । লোকসঙ্গীত লোকের হয়ে ওঠে । বলতে দ্বিধা নেই, এই গ্রন্থের পর্যালোচনা করা, ভক্তিগীতি গায়ক জ্ঞানেন্দ্রনাথ বিশ্বাসকে ঠিক বেঠিক মাপকাঠিতে দাঁড় করানো, তার লাইন বাই লাইন বিশ্লেষণ করা একটু কঠিন । অধিকাংশই আমার জানা ছোঁয়ার বাইরে । আমি যতটুকু উপলব্ধি করেছি, শুনেছি, উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি, তাই নিয়ে আমার পাঠের অভিজ্ঞতা, উঠে আসা অনুষঙ্গ নিয়ে সাধারণ কিছু কথা রাখলাম । লৌকিক সাহিত্য নিয়ে লিখতে বসলে গ্রাস-রুট লেভেলে কাজ করা প্রয়োজন, আখড়ায় ধুলোর মাঝে হাঁটু গেড়ে বসা, হাটখোলায় শিশির পড়া রাতে গান শোনা, প্রান্তিক গ্রামের মাটির ঘরে সাধুগোষ্ঠে যাওয়া অনিবার্য । লোকসাহিত্য লোকের মাঝেই আছে, আর যদি এর ধারক বাহককে আমরা লোক মনে করি । ক্ষমতা, রাজনীতি, ধর্ম, আইন, কানুন, বাজার, মিডিয়া কিছুই তাদের আলাদা করতে পারে নাই । লোক নিজের নিজের মনের মানুষের খোঁজ এখনো জারি রেখেছে, নিজের মতো করেই তারা খোঁজেন, তার কোন ডকুমেন্টেশন নাই, তার কোন পুলিতজার নাই, একাদেমী বা জ্ঞানপিঠ নাই । অথচ আজও গীতিকা বন্ধ হয়ে যায়নি,  হরিবাসরে আজও রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া হয় না, সাধুগোষ্ঠে কেউ নজরুলগীতি গায় না, চুটিয়ে চলছে বিজয় সরকার, অশ্বিনী গোঁসাই, ফটিক গোঁসাই, হরে কৃষ্ণ দাস, মুস্তাকিন শেখ বা  জ্ঞান গোঁসাই । ভক্তিগীতি, দেহতত্ত্বের গান, দেহী মানুষ ও তাদের মঙ্গলামঙ্গল এদের ধর্মাধর্ম, মানুষ এদের উপাস্য, অন্বিষ্ট । এদের জৈব ধর্মবিশিষ্ট দেহে বাস করে ব্রম্মসত্তা, কৃষ্ণ । আজাজিলের নির্মিত দেহে বাস করে আল্লার নুর ।   

এই উচ্চ নীচ, গ্রহণযোগ্যতা, বিক্রয়যোগ্যতা, সুপার মার্কেট, ই-কমার্স জায়ান্ট এমাজোন, ফ্লিপকার্ট, ওয়ালমার্ট নিয়ে যখন ঘাটি গেড়েছে খোদ ভারত বর্ষে, মুনাফালোভী উচ্চ সম্প্রদায়, ব্যাবসায়িক, উচ্চপদস্থ সরকারী বেসরকারি ব্লু-কলার কর্মচারীদের কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ একটা লাইমলাইট জীবন, আলোঝলমলে মহানগর । প্রান্তিক কবিরা থেকে যাচ্ছেন দূরে, কোন দূর সীমানার ওপারে । বাংলার নিজস্ব সাহিত্যের মৌলিকতার প্রতি তাদের কোন দায়বদ্ধতা দেখতে পাই না । শুধু সাহিত্যই নয়, বরং বলা যায় পোশাক, পরিধান, খাদ্য, প্রেম, চুমু, যৌনতা প্রবলভাবে পাশ্চাত্যের অনুকরণে । সেই অনুযায়ী বিক্রয়যোগ্যতা ও সাহিত্যমাধ্যমের দরদাম । বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতিকে আমরা গ্রাম্য বলে দূরে ঠেলে ফেলে দিলাম । পঞ্চায়েত ভোটে অশিক্ষিত চাষাকে পরাজিত করে আনন্দে উল্লাস করে উঠলাম । রাজধর্ম পালন করে বিরাট খেতাব নিয়ে বইমেলা করলাম । কেউ জানতেই পারল না অশ্বিনী গোঁসাইের নাম । কখন যে বিজয় সরকার গেয়ে উঠেছেন “এই পৃথিবী যেমন আছে তেমনই ঠিক রবে , সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে” । আমার বাবাও চলে গেলেন । আনুমানিক ১৯৩৫ সালে বাবার জন্ম, বাংলাদেশের কালীগঞ্জ থানা অন্তর্গত মহাদেবপুর গ্রামে ।
গত ১৪ জুন ২০১৪ তে, নদীয়ার ধানতলার অন্তর্গত হাট-বহিরগাছিতে তার মৃত্যু । এই পৃথিবী থেকে বাবা চলে গেছে, কতবছর হয়ে গেলো ।বহিরগাছি, বিশ্বনাথপুর, প্রতাপগড়, হিমাইতপুর, শেয়ালডাঙ্গা, রুপদহ, বয়ারডাঙ্গি, ট্যাংরা, হাঁসখালি, বগুলা, মুড়াগাছা, কৃষ্ণনগর, কুলগাছি, আসাননগর, ভিমপুর, মালিপোতা, রাণাঘাট, পায়রাডাঙ্গা, বাগদা, হেলেঞ্চার পথে পথে, সাধুগোষ্ঠে, ভাগবত পাঠের আসরে, মহৌতসবে, নামগানে, বাউলের আখড়ায়, হরিকীর্তনে তার জ্ঞানেন্দ্রগীতি জেগে আছে ।

Friday, March 9, 2018

পাঠকামী-২২

পাঠকামী-২২

যা কিছু পড়ার , হাতের কাছে লব্ধ কন্টেন্টের উপর নির্ভর করে থাকি । তা নিজে সংগ্রহ করে বা কারো উপহার । বই , ম্যাগাজিন, ইন্টারনেট নানান সোর্স । ইদানীং যোগ হচ্ছে কুরিয়ার । এটা যে একটা ভালো অপশন, তা এক্সপ্লোর করে দেখি । ডাকে আসা বইগুলির প্রতি একটা আলাদা দায়বদ্ধতা থাকে । পোস্ট অফিস যাওয়া, প্যাকিং করা, স্ট্যাম্প কিনে পোস্ট করা অনেক সময়ের ব্যাপার আর মানসিকতার কেমিস্ট্রি কখন যে পেকে ওঠে মনে জারে, পদার্থ থেকে মৌলগুলিকে ততদিন আলাদা করা যায় না, এই ধরুন “স্বপ্নের জেহাদি ও অন্যান্য গদ্য” বইটি । অনেকবার নিজে ইচ্ছা করেও সংগ্রহ করতে পারিনি । ডাকেই এলো । আজকের পাঠকামিঃ

স্বপ্নের জেহাদি ও অন্যান্য গদ্য প্রদীপ চক্রবর্তী ।

সাধারণত আমি কবিতাই পড়ি, কিন্তু যা দেখছি ক্রমাগত গদ্য পড়ার একটা নেশা বা তাড়না বয়ে বেড়াচ্ছি । যে কোন গদ্যও ঠিক করে উঠতে পারিনি,তবে কবিতা বিষয়ক গদ্য হলে পড়ে ফেলতে পারি একটা বই। তিনটে পর্বে এই বইটাতে মোট পঁচিশটা গদ্য স্থান পেয়েছে । গদ্যগুলি বিভিন্ন সময়ে লেখা, বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় বেরিয়েছে । পাঠক পড়েছে, ভুলে গেছে, হারিয়ে গেছে । পত্রিকাদের কিছু ছিঁড়ে গেছে,কিছু লুপ্ত হয়ে গেছে, সম্পাদকরা অনেকেই সশরীরে আছেন, অনেকেই নেই, অনেকে গা ঢাকা দিয়েছে ।

স্বপনের জেহাদি শুরু হয় সহজ পাঠ দিয়ে, যেভাবে ডেভেলপ হয় কগনিটিভ বোধ, কবিও শেখে, গদ্যকার ও । 'অ' আঁকা থেকে পুরোপুরি বাক্য গঠন, আচমকা শম্ভু রক্ষিত চলে আসেন, দৃশ্যপট ডিসটর্ট হয় । নিজের আমূল ধারনা গেঁথে দেন ভাষ্যের গভীরে । মালকোঁচা আঁটা বাঙ্গালীর ইমেজ হারানোর ভয়ও এক ধরনের আত্মম্ভরিতা । কোন ইম্প্রোভাইজেশন নেই । নেই সম্ভাবনাময় সম্পর্কের মধ্যে সঠিক মুহূর্তকে চিনে নেবার ক্ষমতা । কেবল টি আর পি বাড়ানোর জন্য মুঢ় 'প্যামফ্লিটিয়ারিং' এ নিজেকে রেখে দেওয়ারা দৌড় । সেই মুহূর্তে নিজেকে রাখেন কবি এই সময়ের শক্তিশালী কবি প্রদীপ চক্রবর্তী । 'অনলি হোয়েন উই আর নো লংগার আফ্রেড, উই বিগিন টু লিভ' ।

জীবন্ত বা লাইভ, সরাসরি গা ঝাড়া মেরে উঠে দাঁড়ান কবি, এক গদ্যকারের ভূমিকায় । উঠে আসে কবিতার উৎস, লেখার কাঁচা মাল, শ্রমের আদি তাড়না আর অধ্যবসায়ের নিয়মানুবর্তিতা । বিভিন্ন অনুষঙ্গ আর তার বিস্তৃতি নিয়ে কবিতার নিজস্ব ভূমি তৈরি করতে আসেন কবি । বাংলা বাজারে আজ যারা কবিতা লিখতে এসেছেন, আর যারা কালজয়ী হবার ফন্দিফিকির খুঁজছেন তাদের জন্য রয়েছে গরম হটডগ আর মেক্সিকান চীজ । আধুনিক কবিতার শুরু আর অভিযোজনের প্রতিটা প্রক্রিয়াকে এই গদ্যে ধরে ফেলার অসামান্য কাজ প্রদীপ চক্রবর্তী এত দিন ধরে করে যাচ্ছেন তার ছিটেফোঁটাও আমাদের তরুণ প্রজন্ম জানতে পারছেন না ।

কি করে পারবেন , টি আর পি ছুটে যায় যে ।  যা আজ আছে কাল নেই, তবু কালকের উজ্জ্বল প্রস্তুতির জন্য আজকের ফ্যান ফলোইয়ং কেই বা জলাঞ্জলি দিতে চায় ? এই সব থেকে দূরে , আপন আলয়ে নিভৃতে রচনায় লেগে থাকেন মগ্ন কবি, তুলে  আনেন বিভূতিভূষণের কথা, আনেন উর্মিমালার কথা, সাহিত্য , মননে, মেধার একটা বেঞ্চমার্ক তৈরি করেন কবি প্রদীপ চক্রবর্তী । সিরিজ অফ স্ন্যাপশট । কবিতা নিতে তিনি বক্তব্য রাখেন - " মহৎ কবিতার জন্ম সেই অর্থে আর হয় কিনা , জানি না, মহৎ কবিতায় বিশ্বাসীও নই" । কবিতা তত্বের বাইরে এসে নিজের কবিতা চর্চা করার কথা বলতে চান । কোন এক অখ্যাত অভিযাত্রীর কোন সামান্য অনুভবের তাপে নিজেকে স্নানের কলিং-এ বেজে উঠতে দ্যাখে ।

এখন কবিতা নিয়ে বলতে গেলে, যে শিল্প বোধ আর পাঠকের কথা আসে, সেই পাঠক নিজেই এগিয়ে আসে কবিতার ভিতরে ঢুকতে , কবির চিন্তার পরিসরে ঢুকে পড়েন পাঠক নিজের কবিতা নিয়ে, নিজস্ব পরিপার্শ্ব ও দিন যাপনের অভিজ্ঞতা নিয়ে । কবি প্রদীপ চক্রবর্তী কখনো সেই পাঠক বা কখনো সেই কবি , এক ফ্রেমের ভিতর ঢোকেন, অন্য ফ্রেম ফ্রিজ হয়ে যায় । তার আলোচনা, উদাহরণ, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও আনুষঙ্গিক ঘটনাপ্রবাহ একটা চিত্র গঠন করে, আমি আজ তার গদ্য পাঠ করতে গিয়ে বুঝতে পারছি এই পিপাসা অনন্তের, আবহমান । কবির নিজের গ্রাম দেখা, শহর দেখা, সংসারের টানাপড়েন , কর্মক্ষেত্রের জিজ্ঞাসা পৃথিবীকে নতুন করে চেনায়, তার পছন্দ ও ভালবাসা, তার ব্যক্তিগত ধারনা সমূহ একটা মৌলিক পারসোনাকে চিত্রায়ন করে । তার চ্যালেঞ্জ, দর্শন, সন্ধান, নিজেকে ভাঙ্গা একাকার হয়ে যায় । এই কবিকে পড়তে গেলে তাই তার ভাবনা সমূহকে জানার প্রয়োজন ।  তার উৎস ও বিকাশ , অভিযোজন এই সব আজকের পাঠকদের জন্য অপরিহার্য । অথচ আমরা যেটা প্রতিদিন যা দেখি, বারবার বেশী করে এক্সপ্লানেশন করে দেওয়া, অর্থ সংজ্ঞাবদ্ধ করা , বাণিজ্যে বসতি ও বিজ্ঞাপনের অতিষ্ঠয় একটা কম্ফোর্ট জোনের ভিতর থাকতে চান  । কবি কি তাদেরকে ঘর থেকে টেনে বের করে আনবেন পাঠের ময়দানে ? না । কবি নিজেই একা হয়ে যান । কবি লেখেন ।
"মানুষের ভূগোলের থেকেও সর্বগ্রাসী আধিপত্যবাদের অনুগত পোষ্য জীবে পরিণত না হয়ে নির্জন কুমোঘরে সারাজীবনের ঘোর তাকে অমোঘ সৃষ্টির নেশায় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়" ।

অনেক লেখা, আর অতি যত্নে লেখা বলে লেখাগুলি একটা ঘোরে বেঁধে রাখে । নিজের শৈশব আর লার্নিং প্রসেসগুলি আবার রিভিউ করার একটা সুযোগ আসে । আমরা কি ভাবে পড়তে শিখি,লিখতে শিখি, শিখে নিই মার প্যাঁচ, গাছে চড়া, পড়ে যাওয়া, আবার উঠে যাওয়া, জলে ঝাপ দেওয়া । এই সব আমাদের কগনিটিভ শিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার সূত্রমালা সামনে নিয়ে আসে প্রদীপদা । অনেক জানা কথা, অনেক না জান, অনেক অপ্রকাশিত কথা সমস্তই আজকের এই কবিতার পটভূমি । কবিতা বোধও তো একটা শিক্ষার বাই প্রোডাক্ট । কবি প্রদীপ চক্রবর্তী তাই বারবার শিশুর কথা আনেন তার আলোচনায়, সেখান থেকে ধীরে ধীরে ম্যাচুয়র্ড হতে থাকে চিন্তাসূত্র । পাঠকের কাছে প্রদীপ চক্রবর্তী বোধ্য হয়ে ওঠেন যার কবিতা একসময় পাঠক দুর্বোধ্য বলে সাইড লাইন করে দিয়েছেন । আসলে প্রথম জীবন, সেখান থেকে বেড়ে ওঠা, প্রথম অপটিক্যাল ক্যামেরার চোখে দেখা সাদা কালো ছবি , যা আমরা বড় হয়ে কদাচিৎ সেই ভাবে দেখি, জংলা ফুল, লাল সুরকি রাস্তা, নুড়ি পাথর ঘেরা বাংলো বাড়ি, আঁশটে পোড়া গন্ধ - দৃশ্যের পর দৃশ্যান্তরের বায়স্কোপ । অস্পষ্ট হয়ে আসা স্মৃতি, বালক মন একদিন সমাজ, বন্ধন , রুলস, রেগুলেশন বুঝতে শেখে, কিন্তু মাথার ভিতর থেকে যায় স্বপ্নের বাহন, কিছুটা দাগ রেখে যায় শৈশবের ফুরিয়ে যাবার যাপন সমূহ ।
 
এই ভাবে পড়ে ফেলা যায় তার গদ্যগুলি "স্বপ্নের জেহাদি", "অবেলার টুপুর অলীকে আছে ? " , "চাঁদ ভাঙা পক্ষীরাজ ঘোড়া" । এরপর আসে কিছু পুরানো কবিতার একাডেমিক আলোচনা, তাদের ইতিহাস ও ভূগোল, রবীন্দ্রনাথ, সুধীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, অজিত দত্ত, জীবনানন্দের কথা। আরও অনেক কবিও আসেন, তারা কি দিতে পেরেছে, কি দিয়েছে আর কি দেন নি এবং নতুন কবিতা কী কী দিতে পারে । এইখানে অনেক তত্বকথা আলোচনা করেছেন কবি প্রদীপ চক্রবর্তী, যা নিজেরই বিরুদ্ধে কিছুটা যেখানে তত্বকথা বলবেন না বলে প্রথমেই নস্যাৎ করে দিয়ে শুরু করেছেন । তবে পাঠকের কথা ভেবেই হয়তো "খুশবু--এখানে পিঞ্জর এবং সুচেতনার চোখ" এই গদ্যটির অবতারণা যেখানে তিনি সমসাময়িক কবি ৭০ দশকের বারীন ঘোষাল, শংকর লাহিড়ী, কমল চক্রবর্তী, ৮০ র কবি ধীমান চক্রবর্তী, স্বপন রায়, রঞ্জন মিত্র, অলোক বিশ্বাস, প্রণব পাল, আর্যনীল মুখোপাধ্যায় , রাম কিশোর ভট্টাচার্য, জহরসেন মজুমদার দের কথা উল্লেখ করেন ।


পড়তে পড়তে চলে অনেক চেনা ও না চেনা কবিতার আলোচনা । আমার সীমিত জ্ঞানে ধরার চেষ্টা করি । আমার মনে হয়, কবিতাগুলো আলোচনার সময় তেমনই ব্যক্তিগত কাব্যধারণার বিশেষ এঙ্গেল তুলে ধরেন কবি প্রদীপ চক্রবর্তী । জ্ঞান কখনোই কমপ্লিট নয় । একটা ধারনা মাত্র । কবিতা সেখানে স্ট্যাটিক একটি বিষয় । কবিতার সঙ্গে সঙ্গে গদ্যকারে দৃষ্টিভঙ্গিও প্রকাশ পেতে থাকে । কোন কোন জায়গায় দৃষ্টিভঙ্গি মেলে বা কোন জায়গায় মেলে না । সেটাই স্বাভাবিক । "কিছু স্বপ্নঃ কিছু মুহূর্তঃ কিছু অনুভব", "শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতা", "রাতের ছায়াপথে তিন কবি" । এইগদ্যগুলোতে কবি প্রদীপ চক্রবর্তীর কবিতাযাপনের চিত্র ধরা আছে । তার দৈনন্দিন কাব্য চর্চা, কাব্যধারনা, প্রভাব, অনুশীলন বিভিন্ন কবি ও কবিতার লাইনের ফাকে আবিষ্কৃত হয় । গদ্যের ভাষা, চরিত্র, শব্দচয়ন মুনশিয়ানা রাখে । বোঝা যায় যত্নে লালন করেছেন ।

বইটি পড়তে আমার অনেকদিন লেগে গেলো । আর এই নিয়ে লিখতে আরও বেশী দিন । আমার নিজের সময় কবিতা কম, ক্যাচআপ টাইমেই বেশী লাগে । তারপর যোগসূত্রগুলো জুড়তে খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায় । সেই সঙ্গে একটা পাঠ-দায়বদ্ধতা আমাকে ঘিরে রাখে, চেষ্টা করি, কিছু একটা ব্যক্তিগত মতামত জানানোর । বিশেষ করে যদি কবিতা নিয়ে প্রদীপ চক্রবর্তী ৩০৩ পাতার গদ্য লিখতে পারেন, তবে আমি ৩ পাতার একটা মতামত লিখতে পারবো না ?

বিশেষ রসবোধ চলে আসে "খেয়াল রসের ভোর" গদ্যটা ঘিরে । এইখানে যে প্রদীপ চক্রবর্তীকে আমি চিনি, সেই প্রদীপের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় । কবিতার ভিতর থেকে কবি উঁকি মারে । অনেক অজানা কথার উপস্থাপনা হয় । নিজস্ব গদ্য রচনারও একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে যেতে চান । কিকরে কবি হিসাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন, পাঠ্যবস্তু সংগ্রহ করেছেন । উঠে আসে মণীন্দ্র গুপ্তের কথা, কলেজ স্ট্রীটের কথা, তার বাইরের কথা, রঞ্জিত শিংহের কথা, বারীন ঘোষাল কমল চক্রবর্তীর কথা । আর যেভাবে বাক্য গঠন করেন, মনে হয় অপার যত্নের কথা, মনের গভীর থেকে মন্থন করে উপস্থাপন করে অপূর্ব অক্ষরমালা । একটু উদাহরণ দিই ।
"কবিতা তো অনেক পড়েছি। কখনও আলস্য নেমেছে চোখে, আনন্দের বর্শাফলক মর্মর ভেঙে কখনও মনশ্চক্ষুতে অনুভবের শিখা জ্বালিয়ে তুলেছে শতগুণ । কত ঝোপঝাড় কাঁটার আঁচড় খানা খন্দ বাদা-বাঁওড় ডিঙ্গানো । কত ডাগর চাঁদের বুক জিরানো অনশ্বর আলো "
এগুলো হল কবির ভাষা, কবির গদ্য ।  যে নিজেকে প্রতিক্ষণে কবিতা যাপন করেন ।  তার ভাবনা চিন্তা ভূত ভবিষ্যত কবিতাকে ঘিরে । তাকে আমরা কোন সময় বুঝি , কোন সময় বুঝি না, কোন সময় সে দুর্বোধ্য থেকে যান । কোন সময় নিজেকেই কন্ট্রাডিক্ট করেন । কাগজে লিখে ফেলেন কবিতা,কোন সময় লিখে লাইন কেটে দেন । নতুন কবিতার জন্ম নেয় ।

নতুন কবিতা নিয়েও অনেক কথা আছে এই বইটায় । নতুন কবিতার ধারা, প্রস্তুতি, বিস্তারিত হওয়া, নিজেকে নতুন কবি ট্যাগ করা, এবং তদুপরি ক্রমানুসারে নিজের সাক্ষর আবিষ্কারের মধ্যে রয়েছে তার যাবতীয় লেখ্যবস্তু । নতুন শব্দ, নতুন ভাব ও ব্যবসায়ীদের কি সম্পর্ক সেই নিয়ে তার আক্ষেপ । তার মতে একজন কনভেনশনাল কবি এভারেজ ১৫০-২০০ শব্দের পুঁজি নিয়ে কবিতা লিখতে আসেন, তার লেখায় নষ্ট ফোড়নের ঝাঁঝ কোনদিন আসবে না । এই প্রসঙ্গে তিনি রমেন্দ্রকুমার আচার্যের কথাও আনেন । তার একটি কবিতা নিয়ে আলোচনা - মনোমুগ্ধকর ।

কবি, পাঠককে দেন একটা চিন্তাসূত্র । পাঠক আটকে যান ভাবনাজালে,  নির্জনে বসে ভাববার মতো কোন ধারনা পাঠককে বুঁদ করে রাখে ।  কিন্তু অনেক সময় কবি নিজেই এলিয়েন হয়ে যান । একলা হয়ে যাওয়া তাকে কুরে কুরে খায়, নিঃশেষ হয়ে যেতে থাকেন, কবিও বোধহয় তাই চান । নিজেকে উজাড় করে দেন,  'দুজন পথ ভোলা কবি, একাকীত্বের সাধনা থেকে উপার্জনে' । কবি সজল বন্দ্যোপাধ্যায় কে নিয়ে আলোচনা করেন । ফর্ম নিয়ে কথা হয়, ছেদচিহ্ন নিয়ে কথা হয়, সংকেত, অস্থিরতা, স্বতন্ত্রতা, কনটেন্ট, পরিণাম, আঙ্গিক, চেতনাস্রোত, বিমূর্ততা, আবহ । খোঁজ চলতে থাকে, আপেক্ষিক অস্তিত্বের সমীকরণের কথা সামনে চলে আসে । একটা লাইন তুলে দিই ।  "অবয়বহীন সংবেদিত দুরপনেয় চেতনার সংরক্তিক বিন্যাসে রক্তস্বেদ সংগীতের ঋজুতম দ্বান্দিকতার সহাবস্থানে জারিত দ্বিধাদ্বন্দের উত্থানপতনের ব্যতিক্রমী সংশয়" ।  আর কবির কথা তুলে ধরেন তিনি হলেন রঞ্জিত সিংহ । সুধীন্দ্রীয় ঘরানা, টি এস এলিয়টের, ফ্রয়েড, এডলার ও ইয়ুংএর প্রভাব নিয়ে আলোচনা হয় । সেই সমস্তই আমার অজানা । আমি বুঝলাম কোন রিভিউ হবে অথবা আমারই মতো কোন পাঠকামি । এরপর আলোচিত হন আরেক কবি দেবীপ্রসাদ বন্দোপাধ্যায় । তাদের বেশ কিছু কবিতা নিয়েও আলোচনা হয় ।  আর একজন কবিকেও আলোচনা করেন "একজন প্রডিগ্যাল খালাসির অগ্রন্থিত দহন ও কবিতালিপি" গদ্যে । তিনি হলেন উদয়ন ঘোষ । এই কবিকে আমি কোনদিন পড়ি নাই । কিন্তু এই গদ্যে পড়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম । যেটা প্রদীপ চক্রবর্তী তুলে ধরার চেষ্টা করলেন,  মূলধারার কবিতার কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে কেন্দ্রাতিক চলন, যেখানে বিনির্মাণ, বিগঠন ও বিযুক্তির মধ্যে দিয়ে উৎস কবিতাকে চেনার চেষ্টা করেন । আমার কাছে অজানা হওয়ার কারণে ভাল অনুধাবন করতে পারলাম না ।

নতুন কবিতা আর মূলধারার বাইরে আমি অনেক কথা পড়ি এই গদ্যগুলোতে । আমার কাছে প্রদীপ চক্রবর্তীকে মনে হয়েছে উনি কিছু বলতে চান, কিন্তু এ পর্যন্ত তা ক্লিয়ার হল না । কিংবা হতে পারে আমি পৌঁছাতে পারি নাই । কিংবা আমিও সেই শিশুর মতো প্রশ্ন করতে চাই, এর কি কোন ম্যানিফেস্টো স্থাপন করার আছে ? ব্র্যান্ডিং অপশনগুলি যদি আমি নালিফাই করি, এই গদ্যগুলি সুপাঠ্য, অনেক তথ্যনির্ভর এবং প্রাণ দিয়ে লেখা ।

"অংশত অনুভব , ছেঁড়া ডায়েরীর কয়েকটা পাতা..." আমার বিশেষ করে ভালো লাগলো । এখানেও তিনি কিছু কবির নাম করেন, তাদের সংগে নানান ভাবে ইন্টার‍্যাকশনের কথা আসে । মঞ্জূষ দাশগুপ্তের কথা,  ডায়েরীর তারিখ আসে, সময় আসে, কবিতার রসের কথা আসে, উপভোগের কথা আসে ।  এই সূত্রে কিছু কবিতা পড়াও হয় ।

প্রতিটা গদ্য নিয়ে অনেক কিছু আলোচনা করা যায় । আমার মনে হয় এই গদ্যের বইটি ভালো করে পড়া হয় নাই । তরুণ প্রজন্মের কবিদের জানার দরকার আছে, আজ যারা কবিতা চর্চাকে আলাদা গতি দিয়েছে, তাদের এই পূর্বসূরিদের জানার মত এত ভালো গ্রন্থ আমি দেখি নাই । যেমন গদ্যের ভাষা, তেমন তথ্যের জোগান, তেমন পারসোনিফিকেশন । আমাকে তার যোগ্য পাঠক মনে করে প্রদীপদা দূর দূর্গাপুর থেকে বইটি পাঠিয়েছেন । তাকে আমার ধন্যবাদ ।

বইটির তৃতীয় পর্বে আসে অন্য প্রদীপদা । স্বদেশ সেনের কথা । এযাবৎ সবচেয়ে বেশী আলোচিত কবির নাম । মেনস্ট্রিম বা প্যারালাল - দুধরনের পাঠক সমাজেই দারুণ জনপ্রিয় নাম । আমিও পড়েছি ওঁর কবিতা । "অনুভবের একটা কথা" ,বেশ এনজয় করলাম । ইন্দ্রিয়চেতনা, কবিতা দর্শন, সেই শিশুর কথা ফিরে আসে, কগনিটিভ শিশু, আমিও শিখতে থাকি নতুন পৃথিবী । অনেক কবিতা নিয়ে আলোচনা হয় আর প্রত্যেকটি পাঠে মনে হয় নতুন কবিতা । অনেক জানা কথা, অনেক নাজানা কথা উঠে আসে । লেখকের অনবদ্য লেখনীতে উপভোগ্য হয়ে আসে আলোচনাও । এই পরিণতি পেতে আমাদের আরও কিছু মাইল হেঁটে যেতে হবে ।

"অন্ধকার কারুশিল্পী" গদ্যে কবি সুশীল ভৌমিক নিয়ে লেখেন । তার কবিতা কেন লেখকে নাড়া দিলো তার আলোচনা । "অন্ধকার মামড়ি খসে পড়ে'" গদ্যে আলোচনা করেন কবি ধীমান চক্রবর্তীকে নিয়ে । ব্যক্তি ধীমান চক্রবর্তী, কবি ধীমান চক্রবর্তী, চিন্তাবিদ ধীমান চক্রবর্তী । একমাত্র এই কবির সঙ্গেই আমার মুখোমুখি আলাপ হয়েছে । বলা যায় চেনা ক্ষেত্র । দারুণ ভাবে ধীমান চক্রবর্তীকে ধরেছেন । তথ্যে, ভাষায়, কবিতায় । "স্বপনপারের ডাক শুনেছেন 'জহর'" গদ্যে ধরেছেন জহর সেন মজুমদারকে । এই কবির সম্পর্কে আমি প্রথম শুনি দিল্লির কবি দীপঙ্কর দত্তের মুখে । বিস্তারিত জানা হলো প্রদীপদা গদ্যে । এ ছাড়াও "আশির তিনকবি ও কয়েকটি কবিতার মুহূর্তে" গদ্যে ধরেছেন পার্থপ্রিয় বসু,স্বপন রায়, ও অলোক বিশ্বাসের কথা। বিস্তারিত আলোচনা। উদাহরণসহ । "মুখোশের পোর্টেট" গদ্যে ধরেছেন রতন দাসকে । "উমাপদ করের-পরিযায়ী চলো'" তে কবির কবিতাযাপন, "কাহাদের কথা, হয়তো বা কমলাকান্তের উট" গদ্যে প্রশান্ত গুহ মজুমদার ও রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে লিখেছেন প্রদীপ । "অংশত নব্বই দশকঃ তাপস কুমার লায়েকের একটি কবিতার বই " কিছু কবির নিজেরই কথা  এবং অবশয় তাপসকুমার লায়েক ।   ভাব প্রকাশের পদ্ধতি, বাক্যবন্ধ , শব্দের বহুমাত্রিক ব্যবহারের কথা এমন সময় এমন ভাবে আলোচনা করেছেন যা মাত্র একজন কবির পক্ষেই সম্ভব ।  তার এই গদ্যশৈলী প্রাণবন্ত, তথাকথিত একাডেমিকদের রিভিউ থেকে উপভোগ্য মনে হয়েছে ।

কবি বলেই হয়তো এত কথা জমে থাকে, এত কিছু ভাবা যায় । নানান প্যারামিটারগুলো চোখের সামনে ভাসে । শুধু ধরে ফেলা । কবির চোখে কবিকে দেখা একটা অভিজ্ঞতা তো বটেই, তবে কবি হিসাবে তার নিজের কিছু ধারাবিবরণী থাকে, থাকে নিজস্ব কিছু ভাষ্য । নিজের কবিতা ভাবনা আর চিন্তাসূত্রের বিস্তার । নিজস্ব ধারনা, অভিজ্ঞতা ও তার ব্যাখ্যা । সেটা রং , ধ্বনি, গন্ধে ধরা হয়েছে "একটি অংশত ভেনচারের খসড়া" গদ্যে । আমার কাছে এইটি গদ্যটি  বই থেকে সেরা পাওনা । এখান থেকেই আমি নিজেকেও খুঁজে পাচ্ছিলাম । অসংখ্য ধন্যবাদ । চেতনাপ্রবাহেও খানিকটা বোধহয় বয়ে গেলাম । আমি হয়তো অতটা কবি নই তবে কবিতাবিষয় কনটেন্টেও সম্পূর্ণ মেসমোরাইজড করে পড়িয়ে নিলো প্রদীপ চক্রবর্তী । মনে হচ্ছিলো কোন গোয়েন্দা গল্প পড়ছি । আর খুনি যতই তার সুরাগ মুছে ফেলে , গোয়েন্দা ততই তার চিন্তাজাল ছড়িয়ে দেন  আর মননের আতস কাঁচে তা ম্যাগনিফাই করে ফেলেন । এইতো হলো রুল অব দা গেম । 

Saturday, May 27, 2017

গড়দূরত্বের স্বরলিপিঃ সঞ্জীব নিয়োগী

পাঠকামি -১৯


ডাকে আসা বইগুলোর প্রতি আমার একটু তাড়াহুড়ো থাকে পড়ার  । আর এই দূর দিল্লিতে থাকার কারণে বাংলা বই তেমন পাওয়া যায় না । যা কিছু পাওয়া যায় সব ওই 'বিখ্যাত' কবি বা 'পুরস্কার' প্রাপ্ত বই না বলে যেগুলো  বাংলা বইয়ের দোকান এখানে আছে আছে , তারা রাখে না । আর বাংলা বই সংগ্রহ মানে লিটল ম্যাগ বা বইমেলায় গেলে পর । তাও ব্যাগ ব্যাগেজের কারনে , বোঝা বেশী ভারী করা যায় না । এই মত অবস্থায় কুরিয়ার বালা দরজায়  এলেই আজকাল মনে হয় কেউ বই পাঠিয়েছে । আজকের বই- একটা কবিতার বই, যে কবির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়  নেই বা দেখা সাক্ষাৎ হয় নাই ।

গড়দূরত্বের স্বরলিপিঃ সঞ্জীব নিয়োগী

কবিতার বই আমি আগোগোড়া স্ক্যান করি না । হয় শেষ কবিতা আগে পড়ি কিংবা প্রথমটা প্রথম । বইটার কবিতাগুলির নামকরণ নেই । টাইটেল লেস ।

"কুয়াশার মাঝরাত ভেতরে ভেতরে পাকা ধান । অঘ্রানের পরবের দিকে নিয়ে গ্যালো , খুব ভাত খাওয়া হবে রাতদিন জেগে জেগে..."  - (পাতা-৭) ।

কবিতার বিষয় বস্তু যেখানে ক্ষীণ হয়ে আসে , স্ট্রাকচার জায়গা করে নেয়, ঐটাই প্রধান হয়ে আসে । ধান পাকুক বা না পাকুক অঘ্রাণ চলে আসে । সেই কবিতায় কোন নামকরণ মাইনা রাখে না ।


গ্রামে জন্ম ও বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জেনেছি চুনোপুঁটির কি মানে হয়, আর বোয়ালের জ্যাবড়া কি জিনিস, এর সঙ্গে ছোট নোট আর বড় নোটের মেটাফর ও যেতে পারে , আসলে , কথা কি,  কোন সময়ে দাঁড়িয়ে কোন কথাটা বলা জরুরী, কিভাবে সাধারণ জীবন থেকে গল্প উঠে আসে, সেই ক্রেডিট লেখকেরই প্রাপ্য । 

"অথচ ভালো ভালো শব্দ তো বেশী থাকেনা, গালে হাত বুলোও বা গোলাপ চারায়..." (পাতা-৮) ।

ভালো কবিতার লাইমলাইট নিয়ে যায় আলোকিত সজ্জা, শব্দ ও ছন্দঝংকার । কবির সাধ আহ্লাদ সেখানে গৌন । কেউ যেন বলেছিলো , আমায় নহে গো, ভালোবাসো , শুধু, ভালোবাসো মোর গান । এখন কবিতায় আপনি কি নেবেন ? শব্দ নাকি ছন্দ নাকি গল্প । ভাববাদী ও অলংকারবাদীদের মধ্যে যতই অঘোষিত যুদ্ধ হোক এই কবিতাই নিয়ে আসে আসল উপলব্ধি । গোলাপের চারায় হাত রাখার উপলব্ধির কথা বোধ হয় পাঠক কোনদিন জানতে পারেন না ।

"জেগে জেগেই স্বপ্নগুলোকে মাত্রা আর লাগাম দিতে দিতে অনেকবারই বক্তব্যের দিকে স্পষ্ট ভাবে হেঁটেছে" - (পাতা-১৪) ।

কবিতাগুলো যখন পড়ি । অনেক সময় বাই ইনটিউশন একটা মানে করার প্রবনতা থাকে । এটা আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় । যখন লিখি , শুরুর দিকে তাই থাকে, পরে তার গন্তব্য পালটে যায়, এবং এই যাত্রা নিয়ে পরে যদিও কোন আপসোস থাকে না । কবিতার মাত্রা আর মানে তাই একটা নির্দিষ্ট দিকে যেতে চায়, অন্তত একটা মানে তো দাঁড়াবার কথা । এইখানে হলো মজার কথা । ল্যাঙ্গুয়েজ । কি ভাষায় কবিতাটা লেখা হয়েছে । যেহেতু বাংলাও একটি ভাষা, তাই ঐটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়ে যায় । কবিতারও যে নিজস্ব একটা ভাষা আছে , আর ঐ টা গুলিয়ে যায় । এই খানে লক্ষ্য করার মতো হলো যে 'কার দরকারটা বেশী' । কবির, 'কবিতা বোঝানোর' নাকি পাঠকের 'কবিতা বোঝার' ? বক্তব্য তো একটা রাখতেই হয় ।


তাহলে বাংলা কবিতার আর কি দাঁড়িয়ে থাকলো ? ভাষাটাই যদি না থাকবে, কিছু তার অর্থ ? কি হবে তার বিষয়-আশয় ? এই সব গল্প, কাহিনী আর ছন্দের কোন দাম নাই ?

"অনেক দাম চুকিয়ে আগলে রেখেছ সামান্য ধ্বংসপ্রায়...সহজেই ভুল বুঝোনা, উহ্য থাক ক্রিয়াপদের সরলীকরণঃ এই সাধারন , সমানুপাতিক গা-গতর , কথা শোনো , এমন কোন পতন তোমার ঘটেনি "  (পাতা-১৬)।

এর কি অর্থ হবে ? এই যেন নিজেরই বোধ, নিজেরই কবিতা উঠে আসে । আগেই বলেছি, বক্তব্যতো একটা থাকবেই, আর যেহেতু তাতে কোন ধামাকা নেই, এই সাধারণ কথা দিয়ে আর কতকাল অসাধারণ হবার প্রতিছবি হয়ে থাকবো ? এই কবিতার কি অর্থ । আমি অর্থ মানে টাকা পয়সা , খ্যাতি, যশ, ব্যাংক ব্যালান্স বুঝি ।

কবিতা পড়তে গিয়ে দেখেছি বিস্তর মাঠ পড়ে আছে, নানান ধরনের ফসল ফলানোর জমি । নানার ধরনের রসের আনাগোনা । আসলে দিনের শেষে কবিতা একটা শিল্পই । শিল্পী হিসাবে আপনি কতটা ফাইন করে তুলতে পারেন এইটা আপনার পরীক্ষা । তাতে আপনি যাই করেন ওটা কবিতাই । হারমোনিয়াম পেড়ে ফেলে দুলাইন গলা খাকারি দিলেও ওটা গানই । এর জন্য আপনার তিন তাল বা  দশ তাল না জানলেও চলে আর সাইত্রিশতম রাগীনির খোঁজ না পেলেও । মৌলিক বা যৌগিক এই নিয়ে যোগীরা তো তোলপাড় করে ফেলছে গোটা সোসাল মিডিয়া আর কবি সঞ্জীব নিয়োগী তখন লিখছেন ।

"তেত্রিশ কোটি চুমু পার হয়ে সন্ধ্যা মানে উচ্ছাসের, উচ্ছিষ্টের, সন্নাসের গান । এই যে চাবির মতো কিছু একটা শুয়ে থাকছে অন্তরালময়। তাকে একটু সহজ শরীর খুঁজে দাও" (পাতা-২৭)।

এই খানে 'উচ্ছিষ্ট' কথাটা এমন ভাবে উঠে আসছে, মনে হচ্ছে অপবিত্র হয়ে যাচ্ছে সমস্ত ঈশ্বরীয় চিন্তা ভাবনা আর চর্চিতচর্বনের শিল্প কলা । আর সন্তানের জন্ম দিতে দিতে একদিন সমস্ত শিল্পীরা ক্লান্ত হয়ে আসে, সমস্ত পুরুষমহিলা কবিরা লিংগ নির্বিশেষে মা হয়ে ওঠেন । তখন আর একটা জন্মের জন্য তাদের একটা শরীর দরকার হয় ।

কবিতাতো পাঠ করতেই হয় । পাঠের ভিতর কবিতা লুকিয়ে থাকে । তাকে খুঁজতে হয় ।  মাস্টারি চলে না । বোধের ভিন্নতায় নানান ব্যাখ্যা হয় । কিছুটা কবির সঙ্গেও মিলে যায়, কখনো মেলে না । রসের তারতম্য, বোধের ভিন্নতা সরিয়ে একটা ব্যাপার ফাইন হয়ে ওঠে । তরঙ্গ ছুটতে থাকে । পোয়েম ইস আল এবাউট এ মেটাফর ।

"কিছুক্ষন এই ভাবে থেকে বডি মিহি আইরনির তোয়াক্কার পাশেঃ বারবার পিছলে যায় গুনোত্তর প্রগতির করতলের মতো, উপমা খুঁজতে সকালগুলো গুটি গুটি ক্রমশ পুতুল..." (পাতা-৪২)।

এই ভাবে চলতে থাকে কবি, সরলরেখা বরাবর মেদহীন হেঁটে চলা । উপমার ব্যবহার স্থবীর করে দিয়ে কবির ভাষা ক্রিয়াপদ হীন হয়ে আসে । ক্রমশ । কবিতার চলনে কোন ক্যাট ওয়াক নেই বরং সোচ কা বিচার বা পরিধান বিশেষ উল্লেখ্য । কতটুকু পরলে কোমর দেখা যায় আর কতটুকু পরলে নিতম্ব বেরিয়ে আসে । জিরো ফিগার বেরিয়ে পড়ে কবিতার আলোকময়  চিত্রনাট্যে  ।

কবিতা পাঠ করে আমার কেমন লাগলো ? এক কথায় তান্দুরীর মতো । কামড় বসালে ক্রিস্পি ও কাঠের পোড়া গন্ধ আসে , মাংসের ভিতরে প্রোটিনের আধিক্য নজরে আসে সেখানে ব্রাস মেরে ফ্যাট বাটার লাগাতে হয় । আর স্বাদ তো নিজের মত করেই নিতে হয় । জিভেই কোন রক্ত না লেগে থাকাই সভ্যতার ঝলক । কবিতা সেখানে একটা উপস্থিতি মাত্র , কবি জানাতে চান তার নিজস্ব একটা অবস্থান বাংলা কবিতায় আছে ।

"বুঝতে পারছ উপস্থাপনার ছায়া, ডাক দিচ্ছে সক্রিয়তার ঢেউ । চাঁদ চাঁদ টী নিষ্ক্রিয় কপাল কপালে নিশাচর গোপনের হাসি আর প্রক্ষিপ্ত উপকাহিনীর নির্ভর পান্ডুলিপি" (পাতা ৪৫) ।

আমার পাঠ আজ এই পর্যন্তই থাকলো । নিজস্ব বোধ ও ভাবনা নিয়ে এই পাঠ আগামীতেও চলতে থাকবে । এই পাঠ এবং এর থেকে উঠে আসে আমার ভাবনা , এ আমার নিজস্ব ও আপেক্ষিক । এর কোন বানিজ্যিক মূল্য নেই, বা প্রকাশযোগ্যতাও । মূলত, এই বিদেশে বসে যেটুকু বই পাই তাদের দাম চুকানোর সাধ্য আমার নেই বা সুযোগও থাকে না । সেইটুকু ধন্যবাদ জ্ঞাপন অন্তত আমার এই পাঠকামিতে থাক । এই কবিতা নিয়ে খেলতে থাকা ব্যস্ত কবিদের কপালে চাঁদমামা টী দিয়ে যাক । 

Sunday, May 21, 2017

ফিসফাস কিচেনঃ সৌরাংশু

পাঠকামি -১৮

দিল্লিতে অনেকদিন আছি । নানান ভাবে বাংলা সাহিত্যের নানান উদাহরণ সামনে এসে যায়, তাদের কোনটা পড়তে পড়তে মনে হয় এই দিল্লির সাহিত্যযাপন এক অনন্যসুন্দর ও একান্ত আপন । চাকরিসূত্রেই আসা এই দিল্লি কখন যে এইভাবে আপন বুকে টেনে নেয় আমরা দিলবালা হয়ে উঠি । এইভাবে সৌরাংশুর সঙ্গে কোন ভূমিকা ছাড়াই একদিন পরিচয় হয় দিল্লির বাংলা বইমেলায়, নিউদিল্লি কালিবাড়ীতে । সাহিত্যের কারনেই তার কিছু লেখা যা খানিকটা রম্যরচনা বলে পরিচিত, তার পরিচয় হয়েছিলো ফিসফাসের মাধ্যমে । ফিসফাস ১ , ফিসফাস ২ । যা বের হয়, সব মুড়িমুড়কির মত বিক্রি হয়ে যায় । সেইভাবে কোনদিন পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখিনি । পড়েছি, এবং দিল্লির বাঞ্জরভূমিতে বসে এই সাহিত্যচাষের প্রতিসাক্ষী হতে হতে একদিন হাতে চলে এলো কিচেন ফিসফাস । আজকের বই ।

ফিসফাস কিচেনঃ সৌরাংশু ।

বইটার কোন সূচীপত্র নেই । তো জাহির হে, যখন খানা খাবারের কথা চলছে, ডেফিনিটলি সেখানে মেনুতেই সজ্জিত হয়ে উঠে খাবারের সুগন্ধী তালিকা । মেনু আর সূচি একই জিনিস । মনোরম খাদ্যের অপরুপ সৌন্দর্য্যে জল চলে আসবে জিভেই আর পড়তে গেলেই মস্তিষ্কের কোষে কোষে সৌরভে ভরে উঠবে কল্পনার রেসিপি । ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যাবে এই পাতার পর পাতা, খাবারের কাল্পনিক রসে টইটম্বুর হয়ে উঠবে পাঠকের মন, এইখানে আসে গল্প বলার শৈলী, আর তথ্য আর ইতিহাসের সামঞ্জস্য । খাদ্যের জনপ্রিয়তা আর তার সময়জ্ঞান হিসাবে বিভিন্ন পর্য্যায়ক্রমে সান্ধ্য আড্ডা, ভূরিভোজন, দেশেবিদেশে ও মিস্টিমুখে সৃষ্টিসুখে অধ্যায়গুলিতে একের পর এক কিচেনের গল্প পরিবেশন করে চলেছেন এই বইতে । মান্নাদের সেই গানটা মনে করিয়ে দিচ্ছে । 

"আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না / ইস্তাম্বুল গিয়ে / জাপান, কাবুল গিয়ে  / শিখেছি সহজ এই রান্না ।।  হাতে নিয়ে ডেকচি,/ যেই তুলি হেঁচকি / বিরিয়ানী কোরমা,/ পটলের দোরমা, মিলেমিশে হয়ে যায় 
প্যারিসের ছেঁচকি ...... আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না / খাইবার পাস গিয়ে / রোম , সাইপ্রাস গিয়ে / শিখেছি দারুণ এই রান্না " 

আসলে কিচেনে সবাই একটু আধটু যায়, কেউ চা বানায়, কেউ অমলেট বানায়, কেউ এক গ্লাস জল ভরে নিয়ে এসে খায় । অনেকে আবার গর্বও করেন তার এই পর্যন্তই 'দৌড়' । আবার অনেকে মেয়েদের কাজ বলে 'খুন্তী নাড়া থেকে' দূরেই থাকেন । কিন্তু এই ব্যাপারে আমি জানি সৌরাংশু নিজেই রান্নার ব্যাপারে মস্ত বড় উস্তাদ , রান্নায় আলদা ইন্টারেস্ট ব্যক্তিগত জীবনের অঙ্গ । তার তার এই কথায় কথায় রোম সাইপ্রাস ভ্রমনে একবার বেরিয়ে পড়া যাক ।

যে কোন লাঞ্চ বা ডিনারের মতই তার গল্প শুরু হয় স্টার্টার দিয়ে । চা , সিঙ্গাড়া জলপানের গল্প দিয়ে কিছুটা ইতিহাস ঘুরে আসি । নানান ভূগোলের কথা, দিল্লির চায়ের কথা চলে আসে । চা নিয়ে কোন লেখক কি করেছে, কার গল্পকারের গল্পে কি কিসসা আছে, এই তে বোঝা যায় সৌরাংশু গল্পে একটু সাহিত্যরস নিয়ে আসতে চাইছে । সিঙ্গাড়া নিয়েও চলে আসে আর একগল্পে । নানান দেশের সিঙ্গাড়া আর তার জনমকুন্ডলী খুলে দেখিয়ে দেন কোন দেশে সিঙ্গাড়া কি নাম পরিচিত । যেখানে অবশ্য সৌরাংশু এই রহস্যের সমাধান করেন না যে সিঙ্গাড়ার ভিতর আলু ঢুকলো কি করে ।   

এর পর আসে কফির জগৎ । এই কফিটা একটু বিশেষ মনোযোগ দিয়ে পড়লাম । একবার শুনেছিলাম কফির রাজা স্টারবাক্‌স নাকি কফিতে ড্রাগ মেশায় । কিন্তু সেই খবর পেলাম না কোথাও । যথারীতি সেই ইতিহাস ও ভূগোল । আর ফের সেই মান্নাদে । কফিহাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই । এই টুইস্টগুলোর কারনে লেখাগুলোর পাঠযোগ্যতা বাড়ে । আড্ডা চলতে থাকে ।

ভূরিভোজনের বিরিয়ানীর রান্নার ও রকমভেদ বেশ উল্লেখযোগ্য ও তথ্যনির্ভর । যেভাবে প্রতিবার ইতিহাস ও ভূগোল উঠে আসে, এই বার তার সঙ্গে জুড়ে যায় নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী । লক্ষনৌ , হায়দ্রাবাদী নিয়ে আলাদা আলোচনা । মনে হচ্ছে একদিন খুন্তী কড়াই নিয়ে বসেই পড়বো । ইলিশ চিংড়ি নিয়েও আলোচনা আছে, কিন্তু ছ্যাঁচড়া-চচ্চড়িটা বিশেষ আকর্ষন কাড়ে । কেউতো আজকাল নেমতন্ন করে এই খাবার খাওয়ায় না । খাওয়ার ব্যাপারে বাঙাল আর ঘটিদের আলাদা রকমের পছন্দ ও মারামারি তো আছেই। যেটা আমার সন্দেহ হচ্ছে এই লেখক প্রচন্ড ভাবে মোহনবাগানীয় মনোভাবের আর বড্ড ঘটি পাশঘেষা । এইকারণে আলু, আলু-পোস্ত নিয়ে দুচারটি লেকচার ঝাড়বেন না তা হয় কি ? পোস্তর নানান ইতিহাস ভূগোল তাই থাকবেই । সুতরাং অবসম্ভাবী ভাবে চলে আসে 'দেশে-বিদেশে' অধ্যায় । মিশন কাশ্মীর নিয়ে শুরু । এটা আমার প্রথম চাকরী পর্বত শহর জম্মুর কথা মনে পড়িয়ে দিলো । এর পরেই আসে দক্ষিনী আমিষের কথা । সেকথা বেশী না বলাই ভালো । একবার এক মাদ্রাজীর বাড়িতে মাছের ঝোল খেয়ে হুস হাস করেছিলাম । তিনদিন ভাত খাইনি । বাপরে বাপ কি সেই ঝোল । তেতুলগোলা দিয়ে লঙ্কার বাঁটার ঝোল ! অবশ্য পরের লেখাটি বেশ মজাদার । সিলেটি রান্নার কথা একটু রসিয়েবসিয়ে বলা হয়েছে ।  এরপর আসে মিস্টির কথা, চকোলেটের কথা । ডায়াবেটিসের যুগে সাবধানে থাকা ভালো । নানান রকমের পিঠে পায়েসের লোভ ধরিয়ে দিয়ে এই পাঠ সমাপ্ত করলাম । 

পাঠ বলতে আমি বেশী কল্পনা মিশ্রিত নিমগ্ন পাঠের পক্ষপাতি । সেই কারনে কবিতা ও কবিতা বিষয়ক লেখা পড়তে বেশী ভালোবাসি । সেখানে একটা 'ফাইন' বলে একটা ব্যাপার খুঁজি । যে কারনে আমি নাটক ও দেখি, ক্রিকেট খেলাও দেখি, একটা 'ফাইন' মোমেন্ট দেখার অপেক্ষা থাকে । মোটা করে বললে একটা ব্লকবাস্টার মোমেন্ট ও বলা যায় । গল্প ও কাহিনীতে আমি যেটা খুঁজি সেটা হলো ভাষার বিবর্তন, কল্পনার মিশ্রন, লেখকের নিজস্ব টাচ । কে কিভাবে বলল কথাটা । কি বিষয় আর কি বিশেষ্য আর কি তার ক্রিয়াপদ । গদ্য পড়তে আসা শুধু মাত্র তথ্যের সন্ধানে নয়, সেখানে তার নিজের বাগ্মিতা, যোগ্যতা, পড়াশোনা, রিসার্চ, অনুসন্ধান, দূরদৃষ্টি নানান বিষয় আমার খোঁজে থাকে । গানও এইকারণে শুনি । আর এই বাজারে এত কন্টেন্ট, আর তা এত সহজলভ্য যে তার পাঠ যান্ত্রিকতার দিকে নিয়ে যায় । তারপর নানান জ্ঞান আর সোসালমিডিয়া, কেবলটিভি সমস্ত জ্ঞানগম্ভীর আলোচনা এত তার্কিক হয়ে উঠেছে যে পাঠ ও ক্রমাগত পাঠ্যতা রীতিমত হিমসিম খেয়ে উঠছে । ইন্টারনেট খুললেই যে কোন রেসিপি বা যে কোন খাদ্যের বিবরণ যদি চটজলদী পাওয়া যায় তবে এই বাজারে বসে একজন পাঠক কেন ফিসফাস কিচেন পড়বেন ? 

সেইটা হলো সাহিত্যের চ্যালেঞ্জ, বাংলা সাহিত্যের চ্যালেঞ্জ যেটা সৌরাংশু তুলে নিলেন বৈঠকী কায়দায় । ব্লগের ভাষায় । সুক্ষ্নতা আর অধ্যাবসায়ের মধ্য দিয়ে এই বিশেষ কায়দা ও দক্ষতার সহিত ভাষার বিভিন্ন আঙ্গিক সৌরাংশু কিভাবে পরিবেশেন করেছেন তা জানতে হলে হাতে তুলে নিতে হবে ফিসফাস কিচেন ।


বইঃফিসফাস কিচেন (১ ম পর্ব ) । লেখকঃ সৌরাংশু । প্রকাশকঃ একটি সৃষ্টিসুখ প্রয়াস । মূল্যঃ ভারতীয় মুদ্রা ২২৫ টাকা মাত্র ।  
  

Friday, February 19, 2016

ভূমিকা

সীমানা ছাড়িয়ে


বন্ধু আশরাফ মেসেজ করে জানালেন অনেক দায়িত্ব নিয়ে কবি সৈয়দ শামসুল হক কে সংখ্যা করবে পূর্ব-পশ্চিম । ওর বাড়তি উৎসাহ খুব সংক্রামক । রাত জেগে পত্রিকার কাজ করেন । অন্যদেরও জাগিয়ে রাখেন । আমার কি কাজ ? আমার বাড়ি ও একবার এসেছিলো, কবির একটা বই ও দেখতে পেয়েছিলো । আমাকেও ও সম্ভাব্য লেখকদের তালিকায় ফেলতে চায় । বলল লেখা যোগাড় করে দিতে হবে । বাংলা ভাষার কবি, বাঙ্গালী কবি , ওদের লেখা তো আমাদের টানেই । ভাষার প্রতি আগ্রহ আমাদের সীমানা পার করে নিয়ে যায় অন্য দেশে, কবিতা পড়িয়ে নেয় । 
 


দেখা দেখি


বইমেলা থেকে অনেক বই নিয়ে ফিরেছি, পছন্দের , অপছন্দের, গছানো, দুষ্প্রাপ্য । পড়ার কথা মনে পড়ছে । মনে পড়ে যাচ্ছে রাতের পর রাত কেরোসিন পুড়ে যাচ্ছে, খাতায় না ওঠা গোঁফের ছবি । বীজগণিতের বীজ কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না, দৃষ্টি এড়িয়ে পাশের বাড়ি তামা তামা লোগে, একটা একটা ঘন্টা কালো করে তুলছে ডিম লাইটের কাচ । ছটফটে মন, পরীক্ষার কথা কে এগিয়ে দিয়েছি । খাদ্যের কথাকে চুমুর থেকে আলাদা করেছি, কোন ক্লাসে পড়ি তখন ? শুধু মনে পড়ছে হাফ প্যান্ট, প্রতিটা ক্লাসের তো এই একই সংগ্রাম । মনের ভিতর দাঁত কামড়ে লড়াই করা গদ্য ।আজও 'অব' বা 'অতি', যে কোন চেতনার উপস্থিতিকেই শুধু দেখি, বলার ভঙ্গি কে এখনো কবিতা বলে মনে হয়নি ।

কিছু কবিতার কথা


সিনেমা দেখার সুযোগ কমই পেতাম । যেটুকু ঝলক চোখে পড়তো, শ্রীদেবীর চাঁদনী বা চালবাজে দেখা কোমড়ের মোচড় আর লামহে দেখা ড্যান্স এক অপুর্ব শিল্প মনে হতো । মাধুরীর দিল দেখেছি, বেটাতে তার ধকধক, বলতে কি শরীরে একটু ফ্যাট না থাকলে এই ড্রিম গার্লরা কিভাবে হিটের পর হিট দিতো ? । ড্রিম আজও আছে, ক্যাটওয়াকে আছে ক্যাটেরিনা , কঙ্গনা রানাওয়াত জিন্সটপে জব্বর লাগে । দীপিকারা সমুদ্র সৈকতে ধুমধাম করে নেচে বেড়াচ্ছে, এদের মধ্যে জিরোর জেরে সবাই মেদ ঝরিয়ে পশ্চিমের বার্বি ডল হয়ে ঘরে ঘরে বিদ্যমান । মেদহীন যত শিল্পই আজ চোখে দেখি, মনে হয় কিছুটা বাজারী, কিছুটা ওয়েস্টার্ন , কবিতাও কি মেদহীন হয়ে যাচ্ছে না ? সময় চাইছে , ক্রিটিকস চাইছে । ডাক্তারে বলছে যে ফ্যাট কোলেস্টরেল বাড়ায়, ফ্যাটবর্জিত মাংসের কথা বলছেন । বিশুদ্ধ প্রোটিন ইনটেক শরীরকে তাজা রাখে । সেক্ষেত্রে সয়াবিনই কি বিকল্প হয়ে দাঁড়ায় না ? হয়তো । কিন্তু সয়াবিন খেলে জাত থাকে না ।


সিগনেচার


বহিরগাছি থাকাকালীন আমি বড়দের ক্রিকেট টিমে অতিরিক্ত খেলোয়াড় হিসাবে খেলতাম । কালে ভদ্রে ব্যাটিং পেতাম । কিন্তু যেটা এনজয় করতাম সেটা হলো প্র্যাকটিসে ও ব্রেকে আমাকো পুরো বোলিং করতে দেওয়া হতো । সবাই খুব উৎসাহ নিয়ে আমার বোলিং দেখত, অনেক দর্শক ও ভিড় করে আমার বোলিং দেখতো কারন আমি ইমরান খান, কপিলদেব, প্যাটারসন, ওয়ালস, প্রভাকর, আব্দুল কাদির, মনিন্দর সিং, রবি শাস্ত্রী, ভিভিয়ান রিচার্ডস, ড্যানী মরিশন, রিচার্ড হ্যাডলী এরকম অনেক বোলারের অ্যাকশন হুবহু রিপ্রোডিউস করতাম । সবচেয়ে বেশী তালি পড়তো আব্দুল কাদিরের লেগ স্পিনে । আজকের এই ভাগদৌড় কা জিন্দেগী কা বাজারে একে কি নাম দেবো ? বহুমুখী প্রতিভা নাকি সাক্ষরহীনতা ? যেটুকু বোধ হলো এ পর্যন্ত এসে , তা হলো "নিজের সিগনেচার আবিষ্কার করো" । আজকের বাংলা বাজার ওই ভীড়টানা অ্যাকশনকে মিমিকিরি ছাড়া কিছুই আখ্যা দেয় না ।