পাঠকামি-৬
কিছু পাঠকামি শেয়ার করার পর বুঝতে পারছিলাম যে , কিছু কিছু
ব্যক্তি এটাকে ‘রিভিউ’ বলে ভুল করছেন। কিন্তু একটুই মেসেজ
দেওয়ার ছিলো, এই পাঠকামি আমার একান্তই নিজস্ব পাঠের
অনুভুতি, আর যেহেতু আমি কোন বিশারদ নই তাই, এই কারনে কারো বই বিক্রি বাড়ার কোন রকম
সম্ভাবনা নাই ।
কথা হচ্ছিল কিছু বইয়ের কথা , আর কিছু অ্যাবস্ট্রাক্ট ছবির
কথা যেগুলো বইয়ের পৃষ্ঠায় আটকে আছে । এইসব অনুভূতির কোন ডলার ভ্যালু না থাকা সত্বেও
কিছু পাশ করা ইঞ্জিনীয়ার ফাইল ,প্লাইয়ার, রুলার ,টেপ,
হাতুড়ী কে কলমের মত পকেটে করে বই মেলায় ঘোরাঘুরি করছিলেন । রতনে রতন চেনে, পাঠকে
কবি । সেখানেই হাতে নাতে পরিচয় হলো কবি নীলাব্জের সাথে । বল্লাম, আমি একজন নরম
জাতীয় প্রযুক্তিবিদ, মানে সফটওয়ার ইঞ্জিইয়ার । কবির পোজ দিয়ে আমার একখানি
ছোট্ট ‘ঘুমঘর’ তার হতে তুলে দিই । যবে ঘরে এসে পাত্রখানি উজাড় করি , একি ! ভিক্ষামাঝে দু-দুখানা ‘প্রচ্ছদশিল্পীর ভূমিকায়’ স্বর্ণময়
জ্বলজ্বল করছিলো!! একটা দীপকংর দার জন্য, একটা আমার !
বইঃ প্রচ্ছদশিল্পীর ভূমিকায় – নীলাব্জ চক্রবর্তী
দিল্লি ফেরার পথে ট্রেনের কামরায় এই বইটিকে এক-দুবার হাত
লাগিয়েছিলাম...সে শুধুই টাচ । আজ সে আদুরে কোলের উপর । পাশে শুয়ে আছে ল্যাপটপ ও
অভ্র সফটওয়ার ! যখন ‘উপবৃত্তের সংজ্ঞা’ থেকে
‘মাংসল সম্ভাবনাগুলো নিয়ে / লালচে বোতামবিলাস নিয়ে /
ব্যক্তিগত হয়ে যাচ্ছে’ তখন কবির অনুভূতি আর একলা থাকে না । এখানে অবশ্যই কোন নাটক
নেই, কিন্তু পরিষ্কার বোঝা যায় ক্লাইমেক্সটা ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে এসে সম্পর্কে মিলিয়ে
যাচ্ছে ।
‘আঙুল রাখার রাস্তা/এইভাবে/ কতটা অযৌন হয়ে যাচ্ছে’ –
নীলাব্জ , কবিতাগুলোতে কড়া রং এর দাগ বসিয়ে দেন, ছবিগুলো শিউরে ওঠে । ক্ষয় হতে
থাকে নীলু , তার অস্তিত্ব আর অনস্তিত্বর মধ্যে চলতে থাকে টানা পোড়েন । উদ্বায়ী হতে
থাকে তার গণিত ভাবনা । গান হয়ে ফিরে আসে
রাত । মনে পড়ে যাচ্ছে-
“ওই নিয়মিত বালি ঘড়ির ভেতর /ফুরিয়ে আসছে /আঁকিবুকি কাটার
প্রাচীন একটা দূরত্ব” – আমি ভাবছি, কি ভাবে নীলাব্জ স্মৃতি থেকে তুলে আনে স্বর ,
ড্রিম গার্লের কথা মনে পড়িয়ে দেয় ? পড়লাম ফ্লাসব্যাক, উপবৃত্তের সংজ্ঞা, রাস্তা ।
নীলাব্জের কবিতা এর আগে বেশী পড়িনি, একটা দুটো শূন্যকালে ,
ব্যাস । কবিতায় ও কি বলতে চেয়েছে, ভাবতেই একটা মিথ ভেঙে পড়ে, কোন ধারনা হওয়ার আগেই
ধরন ফেটে চৌচির হয়ে যায় । পড়তে গিয়ে সিটবেল্ট বেঁধে নিতে হয় । লাইন কখন জানি উড়াল দেয় ।
“গাঢ় হাইফেনের পাশে পাশেই কমিক রিলিফের মনোলগ/আর চাকার
পুনরাবিষ্কারের কথায়/পার্কিং লটের সমস্ত মরা ঘাসের কথা” – তোমরা যেখানেই যাও , আমি
এই ঘাসের উপর বসে থাকি। ইন্নোভেশনের ব্যান্ড বাজিয়ে নোনতা জলছাপ নিয়ে খেলা করে
নীলাব্জ চক্রবর্তী । কে ভেবেছে এই ইঞ্জিনীয়ারীয় কবিতার কথা ? বিমূর্ত ছবির আঁচড় ।
ফিরে এসো চাকা ।
‘এক ফোটা নাভি থেকে একটা গ্লিসারিনের দূরত্ব / ছোট হরফের
দিকে বড়ো হরফের দিকে ...ওই রাস্তাটা ক্রমশ নভেম্ববরের দিকে চলে যাচ্ছে’ – এই
রচনাশৈলীটা আমি আগেও দেখেছি... ঠিক মনে পড়ছে না, কপি পেস্ট লাগছে, তবে এটা আমি
এড়িয়ে আমি নভেম্বরে ফোকাসটা রাখি...
“ময়ূরী থেকে একটাই দীর্ঘ সরলরেখা ভিজে ভাব, ভাজক-ভাজিকার
ডাকনাম, এক একদিন...” ও জ্যামিতির কথা বলছিলো, অংকের কথাও ,আমার সামান্য জ্ঞানে
আমি একটু অধিবাস্তবতার ছায়া পাচ্ছিলাম । তবে এ পর্যন্ত যে কটা কবিতা আমি পড়লাম তার
মধ্য শ্রেষ্ট মনে হলো “শোকসভা থেকে ফিরে আসার পর” । এমন কবিতা কদাচিৎ চোখে পড়ে ।
এবার যাত্রা করবো সিনেমাত্রায় ।
“ক্রমশ জলের নীচে এক ফাল্গুন / সরে যাচ্ছে / শীতল পাটির
আরাম ” এর পর অনেকগুলি সিনেমার দৃশ্য পড়লাম । ধরতে পারলাম না । কিন্তু ছোঁয়া থেকে
গেলো । আরেকটি সিনেমার কবিতা হোলো “সিনেমা বিষয়ক”- বিষয়কে ধরে না, কিন্তু বক্তব্য
বলে যায় ।
“ফ্রেমের ভিতর /ফিরে আসছে আরো একটা ফ্রেম.../ আর.../ বৃষ্টি
খুলে ফ্যালা মেয়েরা /গ্রামোফোন পেরিয়ে /চিলেকোঠার ভেতর দিয়ে” – নীলাব্জ ছবির ভিতের
আর একটি ছবি আঁকে । কিছু গানের ব্যবহারে বেমালুম ঠাকুরসাব পেন্নামটা সেরে ফেলেন । ‘ছায়াপথ’ কবিতাটা -
হ্যাভোক । ‘ঋতুবদল’ – সাংঘাতিক বাঁক । ও আজকের যুগের - ‘কথা’ ।
“লিরিকবাস” – মনে হলো এক ট্রেন এমপিথ্রি লোড করে ছুটে আসছে
গান । আর
“মেরুন হচ্ছে গল্পগুলো/ ডোরা কাটছে/রা কাটছে না বাতিল /
পার্চমেন্ট কাগজের স্তুপ...” / “দিনগুলো গোল গোল হতে হতে স্তনের আকার
নিয়ে/ট্যনজেন্ট ...” আমার মনে হয়, ট্যান কথাটা চামড়ার সাথে যায় । সেখানে অংক মেলে
না । খেয়ালখুশীর জায়গা, যেকোন সময় আমি মুখ ডুবিয়ে নিতে পারি মোলায়েম মেদময় শারিরিক
ভাষায় ।
আর একটি দেখুন, “ছোটো ছোটো তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কথামালা/সুর ভুলে
যচ্ছে/কামিজ কাটার জ্যামিতি” এই যে বার বার ২ডি চিত্রমালা ; কখনো নীলাব্জকে একলা
করে না...সে ঐ সব একাকীত্বের কবিতার ধার ধারে না । পাস্ট ইস পাস্ট, ও আজকের কবিতা লেখে
। ওর সঙ্গীত প্রিয়তা একটা বৈশিষ্ট, এটা
দুর্বল কিনা বলার মত কবিতা জ্ঞান আমার নেই, কিন্তু কবি এটা স্বীকার করেছেন যে ওটা
ওর কবিতায় উ-ধার হিসাবে আসে, আর ইটালিক হয়ে কাজ করে । চলুন শেষ কবিতায় একটা চুমুক
দিই।
“ভেঙ্গে ফেলা হলো/সিঁড়ি বিষয়ক যাবতীয় তথ্য/ যা আদতে এক
বাক্স বাড়ির আদলে গড়া /রুপ ও রূপক তৈরীর কারখানা/তার দেওয়ালে কান পাতলে /যুক্তি ও
প্রতিযুক্তির মাঝে হিম হয়ে যাওয়া / একটা শিকল” এটা আমার মনে হলো কবির নিজেরই
কৈফিয়ত বা কবিতা ভাবনা । কবি কি ভেবে এটাই তার বইয়ের শেষ কবিতা রেখেছেন তা আমি
আন্দাজ করতে পারলাম না । কিন্তু আরকিটেকচার অনুযায়ী তিনি যে একটি
পারফেক্ট সিনপসিস সামনে রেখেছেন এটা বলাই বাহুল্য ।
No comments:
Post a Comment