সুফি রংঃ প্রদীপ চক্রবর্তী

পাঠকামি-৪

প্রদীপদার সাথে তেমন পরিচয় কাহিনী নেই , বইমেলায় দেখেছি, একদুবার কথা হইয়েছে । নতুন কবিতার স্টলের বাইরে দেখছিলাম অনেক ভীড় । একদুজন ক্যামেরা হাতে ফটোও তুলছিলো । দাঁড়িয়ে গেলাম । সাথে সব্যসাচী, ভাস্বতী দি । ভীড়টা ছিলো প্রদীপদার কবিতার বই প্রকাশের জন্য । সাক্ষী হয়ে ভালো লাগছিলো । কিন্তু কবিতা সম্পর্কে তেমন কিছু মনে পড়ছে না, আগে ওনার কোন কবিতা পড়েছি ? সব্যসাচী বল্লেন, বই সবাই পড়ুক, পড়া উচিত । হাতে পেলাম ‘সুফি রং’ । পড়ে দেখি ।

বইঃ সুফি রং – প্রদীপ চক্রবর্তী
বইটি এক নজরে ভালো দেখতে । ভিতর ও বাহিরে অন্তরে অন্তরে কি জুড়ে আছে একটু খোলসা করি । ‘রুমানিকা’
‘বেনেবউয়ের বেনেবউ আছে/রংবাহারও একটা মানুষ/সর্বভূক ঢেউ কার ব্রাশে ডুবিয়ে আঁচড় টানছে?’
রং থেকে এখানে একটা অবয়ব আকার নিচ্ছে, রংগুলি শরীর পাচ্ছে, জীবন্ত হচ্ছে ছায়াছবি , প্রদীপদা একটা শরীরের মাঝে প্রতিষ্ঠা করছে প্রান । মনে হয়, নিজের জীবনের খোঁজে,  রঙের প্রতিটা প্রলেপে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন কবিতা যাত্রায় ।
প্রদীপদার লেখার একটা বিশিষ্ট দেখলাম বইটার যেখান থেকে খুশী পড়া যায় । আর প্রদীপদা হয়ত সেটাই চান, মুক্তমনা পাঠকের হৃদয়ে প্রবেশ করতে তার সময় লাগে না। ‘চৈতিবাড়ির গানঃ১৪১৬’ , নাহ, মানে টা বুঝলাম না, পড়ে দেখিঃ
‘বিড়ালের পাশে আই-টি বাজারের মেয়ে/এর মধ্যে মেঘ কোথাও নেই/অনুস্তনে শিশির ভেজাতে ভুলে গেছে দুধ’
এখানে ব্যস্ততার দিনে দৌড়ে চলেছি জলের সাথে, কখনো খেয়ালই করিনি শিশিরটা জমে ছিলো ধানের শীশে, শুধু প্রজাপতির ওড়াটা আমাকে আবেশিত করে রেখেছিলো । একটু আদর আমারও পাওনা ছিলো;
‘একটা সজীব ঘুঘুপাখির ডাক’ পড়ি
‘সে কাজ করে.../শরীরী পাওনা শুধু / পাখিরা/ দুরাশী পাখিদের নাগাল পাওয়া ভার’ – জানি এর এক উড়াল আছে, জানতে ইচ্ছে করে ল্যান্ডিং ও আছে নিশ্চয়ই ‘পাঁজর-শলায় ঘেরা অকূল অথৈ জলে জ্বলজ্বল করছে/ শেষ পাখিটুকু...” এখানে এসে বোঝা যায় ওস্তাদের মার শেষ রাত্রে আরো কিছু কবিতা পড়লাম “দেউলে বাড়ি...বসত বাড়ি”, “ইন্দ্রের ছবি”,”পৃথ্বীরাজ”, “লেখার কথা” , আসলে অনেক কবিতা । 
প্রদীপদা অনেক লেখেন, গোটা বইটাই লিখে ফেলেন, কি জানি সেটাই হওয়া উচিত কিনা, আমার শুধু মনে হচ্ছে কন্টেন্টটা অনেক, পেট ভরে যাওয়ার পরেও বেঁচে থাকবে । প্রদীপদা পাখি নিয়ে খুব লেখেন,
“সারাটি দুপুর /বুনোকাঁটায় ডেকে নিলো পাখির পা” বা “আধা-শব্দের পাখি দেখি আলাদা আলাদা/আসতে দেখি /সমস্ত রাত মনচাষগুলো /নানা মিশ্র-প্রসাদ এবং তীব্র একটা মীমাংসা” – আমি কোন মীমাংসা দেখি না, একটা খোঁজ অবশ্য দেখি, প্রদীপদা পাখি নিয়ে ঘাটেন বটে, তবে ভিন্ন ভিন্ন কন্টেক্সট । কিন্তু প্রশ্ন জাগে এত পাখি কোথা থেকে তিনি আনেন ?
‘জলে আবার নৌকা লেগেছে/ক্ষেতে ফসলে / জলের পাখিরা’ -প্রদীপদা শব্দজব্দও করেন । প্রকৃতিতে মিশে থাকে, আর বয়ে চলেন বাতাসের মত, অবাধ বিচরণ তার । আমার শ্রেষ্ট কবিতা “পাহাড়িয়া মেঘ-বৃষ্টি-পাখির ১৭ টুকরো ব্যর্থতা”
‘উঁচুতে অনামা সেতু/ যা আছে পুনরায় কাঠের ভগ্নাংশেরও নীচে/টেনেটুনে তাকে বের করো রোজ?’ এই অনামা সেতুতে আটকে যায় ভালো লাগা , বার বার তাই প্রদীপদাও লিখে চলে রোজ রোজ ।  আর একটি কবিতার কথা না বললে এই বইটির কথা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে , সেটা হলো “বদল”

“গোধুলি পেরিয়ে/লালবটফল ঝরে পড়ে বহুদিন পরে...যজ্ঞধুমে/বদল হচ্ছে খাঁচার মধ্যে শালিক/শালিকের মাথায় ঝাঁপিভরা সুখদুঃখ...” হয়ত দিনে দিনে বদলে যাবে এই কবিতা যাত্রা, আমার ভালো লাগায় যোগ হবে আরো অনেক বই, তবে ব্যতিক্রমী বই হিসাবে ‘সুফি রং’ বইটি আমার অনেক দিন মনে থাকবে ।

No comments:

Post a Comment