পাঠকামি-১০
জুবিন ঘোষের সাথে ফেসবুকে আলাপ । একদিন চ্যাট বক্সে ধরে তার
কবিতা চেয়ে নিই । ও বলছিলো 'মেগাস্থিনিসের খাতা'
। বইটি আমি পড়ি । ওর কবিতার সাথে পরিচয় হয় । ফোনে ফোনে তার মতামত জানাই । এইবার ঘটনাক্রমে লিটল ম্যাগাজিনের
মেলায় দেখা হয়, তার 'যে কোনও অপশাসনের বিরুদ্ধে' বইটি সংগ্রহ করি ।
যে কোন অপশাসনের বিরুদ্ধেঃ জুবিন ঘোষ ।
ব্লার্বটা পড়ে জানতে পারি শূন্যদশকের কবি । কবিতা লিখছেন অনেকদিন ধরে
। কবিতাগুলি একটা স্পেশাল অ্যাংগল থেকে লেখা । জুবিনের কথায় 'একটা কাব্য দর্শন থাকে' । ভাষা খুব সহজ রাখেন,
বিষয়টাও প্রতিদিনকার, কিন্তু পরিবেশন করেন নিজের আন্দাজে । কাব্য ভাবনাটা নিজস্ব,
এই কঠিন সময়ে দাঁড়িয়ে একজন তরুন কিভাবে তার ভৌগলিক
অবস্থান কে পরিমাপ করেন । প্রতিদিনের রাজনীতি, রাষ্ট্র ব্যাবস্থা,
না খেতে পাওয়া মানুষদের কথা
তাঁকে নাড়িয়ে যায় । বইটি 'ছাগল' নামের কবিতা দিয়ে শুরু করেন । কিছু কবিতা পড়া যাক ।
"দেখতে দেখতে ছাগলটিও একদিন প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে"
(কবিতাঃ ছাগল), আমরা জানি আমাদের
দৌড় কত অব্দি, খাদ্য আর খাদকের জীবন
চক্রে ফেঁসে থাকে আমাদের ছাগল জীবন । বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক ব্যবস্থা
তার কবিতায় বার বার উঠে আসে । শাসকের কথা উঠে আসে । শোষিতের কথা উঠে আসে । গ্রাসরুট লেভেলের কথা লেখেন জুবিন । স্বপ্ন ভঙ্গের কথা লেখেন ।
"লোকে উল্টে ডিটেকটিভ কে সন্দেহ করছে" (কবিতাঃ
ডিটেকটিভ) । আজ আর কোন পক্ষকের সমর্থন দেওয়া যাচ্ছে না, যে রক্ষক সেই ভক্ষক হয়ে দাড়াচ্ছে । ‘যে কোনও অপশাসনের
বিরুদ্ধে' কবিতাটি গুছিয়ে লিখছেন । 'লেভেল ক্রসিং' কবিতাটায় ধরে রেখেছেন উঠতি বয়সের যুবকের চাহনি । লাইন ক্রস করার আগে নিজেকে
ভাবতে চান তিনি । তার কবিতাগুলি ন্যারেটিভ, এটা কে অনেকেই পুরানো যুগের কবিতা বলে নাক চুলকাবেন, কিন্তু বিষয়বস্তুকে সামনে রেখে জুবিন আজকের দিনের
যে সমাজ ব্যবস্থা কে কাটাছেঁড়া করেন তাতে উঠে আসে কারেন্ট টপিক । কঠিন বাস্তব ।
"বিপ্লব কোন ধারনা নয় / হাতের উপর হাত রাখা"
(কবিতাঃ বিপ্লব), এটাই বোধহয় এই বইটির
সেরা কবিতা । মানুষের পেটের কথা, রোজগার, গ্রামের সমস্যা, সোমালিয়ার খাদ্য সমস্যা তাঁকে ভাবায় । কিছুটা পলিটিক্যাল বক্তব্য
রাখেন কিন্তু পাঠকের উপর চাপিয়ে দেন না । কুকুর নিয়ে কবিতা লেখেন, মানুষের অবস্থার কথা লেখেন, গ্রাম ও গঞ্জের সাধারন মানুষদের কথা পৌঁছে দেন পাঠকের কাছে । 'সোনা হারিয়ে' এমনই একটা কবিতা । আর একটা কবিতা খুব ভালো লেগে
গেলো, 'দুর্যোধনের বিলাপ'
। একটা অসহায় ব্যবস্থার কথা, পৌরানিক চরিত্র কিন্তু
আজকের পটভূমিতে ।
"লেজ যত আধুনিক হয়, কবিটির দর বাড়িয়া ওঠে " (কবিতাঃ ল্যাজ হইলে
প'রে) । এই কবিতাটা অন্য জাতের । সাধু ভাষায় লেখা । স্যাটায়ার । যারা গেল গেল বলে চেল্লাচ্ছেন, তাদের প্রতি । আঠার বয়সের জওয়ানের কথা অনেক
বৃদ্ধ বুদ্ধিজীবিদের মাথায় ঢুকবে না ।
এই বইটির শেষ কবিতা টি বোধহয় কবিকে পরিপূর্ণ করে
তোলে । বড় যত্ন নিয়ে লেখা ।
"যারা আঙুল চোষে, তাদের জন্য আমারও কোন সমবেদনা নেই"
(কবিতাঃ মিগ বিমান থেকে দেখা) । বড় বলিষ্ট উচ্চারন । কলমে হঠাতই ঝোড়ো হাওয়া । বুকের ভেতরে ড্রেজার চালিয়ে চাষ করে আনেন কবিতা । দীর্ঘ কবিতা । অনেক কথা যখন বলার
থাকে, কবিতা দীর্ঘ হয়ে যায় । বেশ লেগেছে কবিতাগুলি । তুলনা করা যদিও ঠিক না,
তবে মেগাস্থিনিসের খাতার কবিতাগুলি
আমার আরও বেশী ভালো লেগেছিলো । আসলে চাহিদা বাড়তে থাকে । আশা আরও বাড়িয়ে তুলবেন কবি । জুবিনের
কবি জীবন আরো কবিতাময় হৌক । কামনা করি তরুন প্রজন্মের কাছে জুবিন একটা বিশ্বস্ত
মুখ নিয়ে এসে দাঁড়াক ।
No comments:
Post a Comment