আমার দেখা দিল্লির বইমেলা
পীযূষকান্তি বিশ্বাস
আমার দেখা দিল্লির বইমেলা সম্পর্কে বলতে হলে শুরু করতে হয় আমার বইপ্রেম নিয়ে, দিল্লি নিয়ে, ও বইমেলা নিয়ে । প্রত্যকটি বিষয়ের উপর একজন উদীয়মান বাংলা কবির পটভূমিতে আমার দেখা বইমেলার স্মৃতিগুলোকে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি ।
সেবার দিল্লিতে পোস্টিং নিয়ে আসা, সন ১৯৯৮ এর কথা । হিন্দি তখনো ভালো করে রপ্ত করে পারিনি । বাংলাভাষার প্রতি তাই অতিমাত্রায় টান । এ শহরে প্রথম পা দিয়ে বুঝলাম, এর পাথুরে মাটিতে নানা জাতির , নানা ভাষার অনেক ইতিহাস হেঁটে গেছে । দূর দূর ছড়িয়ে আছে তার স্ক্রিপ্ট । বাংলা বইয়ের খোঁজে পালাম থেকে সাইকেলে করে যেতাম দক্ষিন দিল্লির কালীবাড়ী, ওখানে একটা বাংলা বইয়ের লাইব্রেরী ছিলো । বন্ধুদের মধ্যে দু একজন মাত্র পড়ুয়া ছিলো, বাকি সবাই পিয়াক্কড় । প্রতিদিন দিল্লি শহরের বিস্তার দেখে পুলকিত হতাম । এর মধ্যে একদিন খবর পেলাম সাপ্রু হাউসে বাংলা বইমেলা হচ্ছে । আইডিয়া নেই সঠিক কোথায় তার অবস্থান । এইটুকু বোঝা গেল ওটা বঙ্গভবনের কাছাকাছি কোথাও । বঙ্গভবন আবার কি ? ওটা হেইলি রোডে । আবার হেঁয়ালি, হেইলি রোড কি ? কোন দাদা, নেই। কোন মায়-বাপ নেই, একদিন অফিস ছুটি করে বেরিয়ে পড়লাম অজানায় । ঠিক মনে নেই যাত্রাপথ, কিন্তু সাপ্রু হাউস খুঁজে খুঁজে সেই আমাদের দিল্লির বইমেলা আবিষ্কার । একেবারে বাঙালী বইমেলা । অনেক বাংলা বই সারি সারি সাজানো আর অনেক লোক বাংলায় কথা বলে । আমি এই প্রথম কোথাও বইমেলা দেখলাম । দিল্লির আয়তন আমার কাছে তখন আরও অনেকগুন বেড়ে গেলো ।
ঠিক কটা বই কিনেছিলাম সেবার বইমেলায় ? মনে নেই । কবিতার বই বেশী পড়তাম না, ওই গোয়েন্দা গল্পের প্রতি বেশী আগ্রহ থাকতো । সমরেশ বসুর উপন্যাস ভালো লাগত । বিদেশী লেখকের বাংলা অনুবাদের প্রতি আলাদা আগ্রহ থাকত । সেই বইমেলায় দিল্লি আর বাংলা সাহিত্যের যে কি সম্পর্ক বোঝার মত বুদ্ধি ছিলো না । যেটা ছিলো বিদেশের মাটিতে গড়ে ওঠা একাকী পাঠকের পিপাসিত হৃদয় আর কিছু অপঠিত কিছু অক্ষরের প্রেম । নির্ভেজাল পাঠক ছিলাম । এর পর কেটে গেছে অনেক বছর পালামেই । বেশ কবছর রুটির নিরাপত্তাকে তালিকায় সামনে রেখে কদম কদম বাড়িয়ে গেছি নয়ডা আর গুড়গাঁও । বৃহত্তর দিল্লিকে আরও চিনেছি, ইন্ডিয়া গেট আর কাশ্মীর গেটের পার্থক্যও শিখে গেছি , রাজঘাট আর যমুনার পাড়ের সম্পর্ক বুঝেছি , আর দেখেছি দিনে দিনে কিভাবে যমুনা তার নাব্যতা হারিয়েছে ।
সেটা ঠিক ২০১৩ হবে, লেখালেখির দুনিয়ায় কদম বদলে গেল হঠাৎ কিছু ঘটনায় । ব্লগে ব্লগে, ফেসবুকে, ওয়েবজিনেকবিতা লিখে লিখে বেশ পরিচিত হচ্ছি, বেশ কয়েকটি পত্রিকায় কবিতা প্রকাশ পাওয়ায় স্থানীয় কিছু বন্ধুরা আরও উৎসাহিত করতে লাগলেন, পাঠকের পা থেকে হেঁটে বেরিয়ে আসছি আমি । পালাম থেকে বেরিয়ে একদিন মুক্তধারাতে পৌঁছে গেলাম । ব্রততীদির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন জয়শ্রী রায় । নিজের পরিচিতি বৃদ্ধির সাথে সাথে চিনে নিচ্ছিলাম দিল্লির বাংলার মুখপাত্রগুলো ।
যা হোক, সে বছর থেকে নিয়মিত আমি দিল্লির বাংলা বইমেলায় আসতাম । আসতাম মানে কি, উক্ত বইমেলায় গোপাল বাবু ওরফে গোপাল চন্দ্র পাল যাতে স্টল নেন এবং সেই স্টলে যাতে আমরা বসে আড্ডা দিতে পারি সেই জন্য আমি অনেক কবি কে আগে থেকে খবরাখবর করতাম । গোপালবাবুর স্টলে আমরা কবিতা পাঠ করতাম । কলকাতা, ঢাকা, আগরতলা থেকে আসা অনেক প্রকাশনার অনেক বই কিনতে পারতাম, অনেক ম্যাগাজিন উল্টে পালটে দেখতাম আর ভাবতাম নামী পাবলিশার্সরা কেমন হয় একটু দেখা যাক, যা হোক একটু লেখালেখি তো করি, যদি কোনদিন নিজের কোন বই বের করতে হয় । সদ্য লেখক হয়ে ওঠা 'আমি'র পক্ষে এই সুযোগটা তো অবশ্যই নেওয়া যায় ।
২০১৩ বইমেলার একটি দৃশ্য, আমি আর আমার ছেলে ঋজুস্মিত বই কিনে ফিরছি ।
এই বইমেলায় এই প্রথম সৃষ্টিসুখের স্টল দেখি, রম্যরচনাকার সৌরাংশুর সাথে পরিচয় হয় । ঈশিতা ভাদুড়ী, প্রান জি বসাক, শুভ্র বন্দোপাধ্যায় এই কবিদের নামগুলো আমি শুনি । আয়োজক তপনদার সাথে পরিচয় হয় । কলকাতার অনেক সাহিত্যিক আসেন, দিল্লিবাসী হয়ে ওদের অনেকের নামই অজানা, তাদের আলোচনা শুনি । নির্ভেজাল বসে থাকতাম বইমেলায় । স্টেজে কবিতা পড়তেন অনেক কবি তাদের কাউকেই চিনতাম না । বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মজা নিতাম । স্টলের বাইরে ঝালমুড়ী নিয়ে বসত এক মহিলা, মাঝে মাঝে তার কাছ থেকে ঝালমুড়ি কিনে আনতাম আর গোপালবাবুর স্টলে বসে হিসাব করতাম আমরা বাংলা সাহিত্যের কোথায় ঠিক দাঁড়িয়ে আছি ? হিসাব করতে করতে আরও এক বছর ঘুরে আসে । গোপালবাবু আবার স্টল নিলেন ।
গোপালবাবুর স্টলে কবিতা পড়ছি আমরা
বইমেলা ২০১৪ । আর এবার আমি সুযোগ পেলাম বইমেলার স্টেজে কবিতা পড়ার । কবি অগ্নি রায় ও আকাদেমী বিজেতা নবারুন ভট্টাচার্যের সাথে এই মঞ্চে কবিতা পড়ার সুযোগ পাই । দিল্লির বাংলা বইমেলায় অনেক কিছুর অভাব অনেকেই বলে থাকেন, কিন্তু অনেক এই রকম ছোট ছোট প্রাপ্তির কথা উল্লেখ করতে ভুলে যান ।
কবিতা পড়ছি বইমেলার মঞ্চে অন্যান্য কবিদের সাথে
এই বইমেলায় আমার প্রথম বই প্রকাশ হলো । যদি ঠিক অনুমান হয়, দিল্লির বাংলা বইমেলা উপলক্ষে এই প্রথম কোন বাংলা বই প্রকাশ হলো । দিলীপ ফৌজদার, গৌতম দাশগুপ্ত, কৃষ্ণামিশ্র ভট্টাচার্য আর আমার এক যোগে চারটি বই বের হয় । বইগুলির মোড়ক উন্মোচন করেন কলকাতার বিখ্যাত সাহিত্যিক কিন্নর রায়, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য, রবিশঙ্কর বল ।
আমার বই ঘুমঘরের মোড়ক উন্মোচন দৃশ্য
ঘুমঘর বইটি আমার বিভিন্ন স্টলে ছড়িয়ে দিই । এই প্রথম আমি কবি হওয়া অনুভব করি । ছোট্ট একটি অংকুরকে ফুটতে দেখে আমার শুভাকাংখীরা আমাকে আলো বাড়িয়ে দিতে থাকেন । দিল্লির অন্যান্য কবিদের কাছে থেকে অভ্যর্থনা পেতে থাকি, সঠিক অর্থে এই ক্ষেত্রে আমি পালাম মহাবীর এনক্লেভ থেকে বেরিয়ে দিল্লির বাংলা সাহিত্যের মেন স্ট্রীমে মিশে যাই ।
আমার মত যারা তরুন কবি বা ছোট খাটো লেখক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন দিল্লির কোনে কোনে তাদেরকে এক মিলন ক্ষেত্র করে দিয়েছে । সত্তর বা আশির দশকের যে নামকরা বাংলা কবিরা দিল্লিতে রয়েছেন তাদের সাথে মিশে যেতে এমনই একটা আয়োজনের দরকার । এমনই এক মিলন মেলায় আমরা দিল্লির বুকে খুঁজে পাই প্রায় ৫০ জন বাংলা কবির ঠিকানা যারা নিয়মিত এখনো বাংলা ভাষায় বিভিন্ন আঙ্গিকে কবিতা লিখে চলেছেন । আধুনিক থেকে আধুনিকতর কবিও যেমন রয়েছেন তেমনি প্রবীন ধ্রুপদী কবিদের মিলন হয় মেলা পরবর্তী সময়ে 'পাঞ্চজন্য' নামের এক অনুষ্ঠানে । নবীন ও প্রবীন কবিদের একযোগে কবিতা পাঠের আসর করা হয় যার সুত্রপাত এই বইমেলা থেকে শুরু হয় । আবারো বইমেলা হবে । এরকমই আরও কিছু লেখকের আশায় আবার ও বইমেলায় যাবো, বই কিনবো, লেখকদের সাথে পরিচিত হবো, এই করে করে আরও একটা বইমেলা কেটে গেছে । গোপাল বাবু অসুস্থ থাকার কারনে আর স্টল নেয়নি । আর স্টল নেবেন ও না কারন উনি আজ আর আমাদের মধ্যে নেই ।আর নতুন প্রজন্মের কাছে আমরা এক নতুন প্রকাশকের খোঁজে থাকব । বেংগল আসোসিয়েশনের আয়োজনে বইমেলা হয়তো তাই হয় চলতেই থাকবে ।
বইমেলার এই সব ছোট খাটো অভিজ্ঞতা এক এক জনের কাছে এক এক রকম পাওয়া । আমার কাছে বইমেলা একটা ঠিকানা, দৌড়াতে থাকা জানজটময় এই পাথুরে দিল্লির দেওয়ালে একটা জানালা । যার কপাট খুললে অপার আলো, আর বন্ধ করে দিলে বন্ধ হাভেলী ।
পীযূষকান্তি বিশ্বাস
আমার দেখা দিল্লির বইমেলা সম্পর্কে বলতে হলে শুরু করতে হয় আমার বইপ্রেম নিয়ে, দিল্লি নিয়ে, ও বইমেলা নিয়ে । প্রত্যকটি বিষয়ের উপর একজন উদীয়মান বাংলা কবির পটভূমিতে আমার দেখা বইমেলার স্মৃতিগুলোকে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি ।
সেবার দিল্লিতে পোস্টিং নিয়ে আসা, সন ১৯৯৮ এর কথা । হিন্দি তখনো ভালো করে রপ্ত করে পারিনি । বাংলাভাষার প্রতি তাই অতিমাত্রায় টান । এ শহরে প্রথম পা দিয়ে বুঝলাম, এর পাথুরে মাটিতে নানা জাতির , নানা ভাষার অনেক ইতিহাস হেঁটে গেছে । দূর দূর ছড়িয়ে আছে তার স্ক্রিপ্ট । বাংলা বইয়ের খোঁজে পালাম থেকে সাইকেলে করে যেতাম দক্ষিন দিল্লির কালীবাড়ী, ওখানে একটা বাংলা বইয়ের লাইব্রেরী ছিলো । বন্ধুদের মধ্যে দু একজন মাত্র পড়ুয়া ছিলো, বাকি সবাই পিয়াক্কড় । প্রতিদিন দিল্লি শহরের বিস্তার দেখে পুলকিত হতাম । এর মধ্যে একদিন খবর পেলাম সাপ্রু হাউসে বাংলা বইমেলা হচ্ছে । আইডিয়া নেই সঠিক কোথায় তার অবস্থান । এইটুকু বোঝা গেল ওটা বঙ্গভবনের কাছাকাছি কোথাও । বঙ্গভবন আবার কি ? ওটা হেইলি রোডে । আবার হেঁয়ালি, হেইলি রোড কি ? কোন দাদা, নেই। কোন মায়-বাপ নেই, একদিন অফিস ছুটি করে বেরিয়ে পড়লাম অজানায় । ঠিক মনে নেই যাত্রাপথ, কিন্তু সাপ্রু হাউস খুঁজে খুঁজে সেই আমাদের দিল্লির বইমেলা আবিষ্কার । একেবারে বাঙালী বইমেলা । অনেক বাংলা বই সারি সারি সাজানো আর অনেক লোক বাংলায় কথা বলে । আমি এই প্রথম কোথাও বইমেলা দেখলাম । দিল্লির আয়তন আমার কাছে তখন আরও অনেকগুন বেড়ে গেলো ।
ঠিক কটা বই কিনেছিলাম সেবার বইমেলায় ? মনে নেই । কবিতার বই বেশী পড়তাম না, ওই গোয়েন্দা গল্পের প্রতি বেশী আগ্রহ থাকতো । সমরেশ বসুর উপন্যাস ভালো লাগত । বিদেশী লেখকের বাংলা অনুবাদের প্রতি আলাদা আগ্রহ থাকত । সেই বইমেলায় দিল্লি আর বাংলা সাহিত্যের যে কি সম্পর্ক বোঝার মত বুদ্ধি ছিলো না । যেটা ছিলো বিদেশের মাটিতে গড়ে ওঠা একাকী পাঠকের পিপাসিত হৃদয় আর কিছু অপঠিত কিছু অক্ষরের প্রেম । নির্ভেজাল পাঠক ছিলাম । এর পর কেটে গেছে অনেক বছর পালামেই । বেশ কবছর রুটির নিরাপত্তাকে তালিকায় সামনে রেখে কদম কদম বাড়িয়ে গেছি নয়ডা আর গুড়গাঁও । বৃহত্তর দিল্লিকে আরও চিনেছি, ইন্ডিয়া গেট আর কাশ্মীর গেটের পার্থক্যও শিখে গেছি , রাজঘাট আর যমুনার পাড়ের সম্পর্ক বুঝেছি , আর দেখেছি দিনে দিনে কিভাবে যমুনা তার নাব্যতা হারিয়েছে ।
সেটা ঠিক ২০১৩ হবে, লেখালেখির দুনিয়ায় কদম বদলে গেল হঠাৎ কিছু ঘটনায় । ব্লগে ব্লগে, ফেসবুকে, ওয়েবজিনেকবিতা লিখে লিখে বেশ পরিচিত হচ্ছি, বেশ কয়েকটি পত্রিকায় কবিতা প্রকাশ পাওয়ায় স্থানীয় কিছু বন্ধুরা আরও উৎসাহিত করতে লাগলেন, পাঠকের পা থেকে হেঁটে বেরিয়ে আসছি আমি । পালাম থেকে বেরিয়ে একদিন মুক্তধারাতে পৌঁছে গেলাম । ব্রততীদির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন জয়শ্রী রায় । নিজের পরিচিতি বৃদ্ধির সাথে সাথে চিনে নিচ্ছিলাম দিল্লির বাংলার মুখপাত্রগুলো ।
যা হোক, সে বছর থেকে নিয়মিত আমি দিল্লির বাংলা বইমেলায় আসতাম । আসতাম মানে কি, উক্ত বইমেলায় গোপাল বাবু ওরফে গোপাল চন্দ্র পাল যাতে স্টল নেন এবং সেই স্টলে যাতে আমরা বসে আড্ডা দিতে পারি সেই জন্য আমি অনেক কবি কে আগে থেকে খবরাখবর করতাম । গোপালবাবুর স্টলে আমরা কবিতা পাঠ করতাম । কলকাতা, ঢাকা, আগরতলা থেকে আসা অনেক প্রকাশনার অনেক বই কিনতে পারতাম, অনেক ম্যাগাজিন উল্টে পালটে দেখতাম আর ভাবতাম নামী পাবলিশার্সরা কেমন হয় একটু দেখা যাক, যা হোক একটু লেখালেখি তো করি, যদি কোনদিন নিজের কোন বই বের করতে হয় । সদ্য লেখক হয়ে ওঠা 'আমি'র পক্ষে এই সুযোগটা তো অবশ্যই নেওয়া যায় ।
২০১৩ বইমেলার একটি দৃশ্য, আমি আর আমার ছেলে ঋজুস্মিত বই কিনে ফিরছি ।
এই বইমেলায় এই প্রথম সৃষ্টিসুখের স্টল দেখি, রম্যরচনাকার সৌরাংশুর সাথে পরিচয় হয় । ঈশিতা ভাদুড়ী, প্রান জি বসাক, শুভ্র বন্দোপাধ্যায় এই কবিদের নামগুলো আমি শুনি । আয়োজক তপনদার সাথে পরিচয় হয় । কলকাতার অনেক সাহিত্যিক আসেন, দিল্লিবাসী হয়ে ওদের অনেকের নামই অজানা, তাদের আলোচনা শুনি । নির্ভেজাল বসে থাকতাম বইমেলায় । স্টেজে কবিতা পড়তেন অনেক কবি তাদের কাউকেই চিনতাম না । বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মজা নিতাম । স্টলের বাইরে ঝালমুড়ী নিয়ে বসত এক মহিলা, মাঝে মাঝে তার কাছ থেকে ঝালমুড়ি কিনে আনতাম আর গোপালবাবুর স্টলে বসে হিসাব করতাম আমরা বাংলা সাহিত্যের কোথায় ঠিক দাঁড়িয়ে আছি ? হিসাব করতে করতে আরও এক বছর ঘুরে আসে । গোপালবাবু আবার স্টল নিলেন ।
গোপালবাবুর স্টলে কবিতা পড়ছি আমরা
বইমেলা ২০১৪ । আর এবার আমি সুযোগ পেলাম বইমেলার স্টেজে কবিতা পড়ার । কবি অগ্নি রায় ও আকাদেমী বিজেতা নবারুন ভট্টাচার্যের সাথে এই মঞ্চে কবিতা পড়ার সুযোগ পাই । দিল্লির বাংলা বইমেলায় অনেক কিছুর অভাব অনেকেই বলে থাকেন, কিন্তু অনেক এই রকম ছোট ছোট প্রাপ্তির কথা উল্লেখ করতে ভুলে যান ।
কবিতা পড়ছি বইমেলার মঞ্চে অন্যান্য কবিদের সাথে
এই বইমেলায় আমার প্রথম বই প্রকাশ হলো । যদি ঠিক অনুমান হয়, দিল্লির বাংলা বইমেলা উপলক্ষে এই প্রথম কোন বাংলা বই প্রকাশ হলো । দিলীপ ফৌজদার, গৌতম দাশগুপ্ত, কৃষ্ণামিশ্র ভট্টাচার্য আর আমার এক যোগে চারটি বই বের হয় । বইগুলির মোড়ক উন্মোচন করেন কলকাতার বিখ্যাত সাহিত্যিক কিন্নর রায়, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য, রবিশঙ্কর বল ।
আমার বই ঘুমঘরের মোড়ক উন্মোচন দৃশ্য
ঘুমঘর বইটি আমার বিভিন্ন স্টলে ছড়িয়ে দিই । এই প্রথম আমি কবি হওয়া অনুভব করি । ছোট্ট একটি অংকুরকে ফুটতে দেখে আমার শুভাকাংখীরা আমাকে আলো বাড়িয়ে দিতে থাকেন । দিল্লির অন্যান্য কবিদের কাছে থেকে অভ্যর্থনা পেতে থাকি, সঠিক অর্থে এই ক্ষেত্রে আমি পালাম মহাবীর এনক্লেভ থেকে বেরিয়ে দিল্লির বাংলা সাহিত্যের মেন স্ট্রীমে মিশে যাই ।
আমার মত যারা তরুন কবি বা ছোট খাটো লেখক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন দিল্লির কোনে কোনে তাদেরকে এক মিলন ক্ষেত্র করে দিয়েছে । সত্তর বা আশির দশকের যে নামকরা বাংলা কবিরা দিল্লিতে রয়েছেন তাদের সাথে মিশে যেতে এমনই একটা আয়োজনের দরকার । এমনই এক মিলন মেলায় আমরা দিল্লির বুকে খুঁজে পাই প্রায় ৫০ জন বাংলা কবির ঠিকানা যারা নিয়মিত এখনো বাংলা ভাষায় বিভিন্ন আঙ্গিকে কবিতা লিখে চলেছেন । আধুনিক থেকে আধুনিকতর কবিও যেমন রয়েছেন তেমনি প্রবীন ধ্রুপদী কবিদের মিলন হয় মেলা পরবর্তী সময়ে 'পাঞ্চজন্য' নামের এক অনুষ্ঠানে । নবীন ও প্রবীন কবিদের একযোগে কবিতা পাঠের আসর করা হয় যার সুত্রপাত এই বইমেলা থেকে শুরু হয় । আবারো বইমেলা হবে । এরকমই আরও কিছু লেখকের আশায় আবার ও বইমেলায় যাবো, বই কিনবো, লেখকদের সাথে পরিচিত হবো, এই করে করে আরও একটা বইমেলা কেটে গেছে । গোপাল বাবু অসুস্থ থাকার কারনে আর স্টল নেয়নি । আর স্টল নেবেন ও না কারন উনি আজ আর আমাদের মধ্যে নেই ।আর নতুন প্রজন্মের কাছে আমরা এক নতুন প্রকাশকের খোঁজে থাকব । বেংগল আসোসিয়েশনের আয়োজনে বইমেলা হয়তো তাই হয় চলতেই থাকবে ।
বইমেলার এই সব ছোট খাটো অভিজ্ঞতা এক এক জনের কাছে এক এক রকম পাওয়া । আমার কাছে বইমেলা একটা ঠিকানা, দৌড়াতে থাকা জানজটময় এই পাথুরে দিল্লির দেওয়ালে একটা জানালা । যার কপাট খুললে অপার আলো, আর বন্ধ করে দিলে বন্ধ হাভেলী ।
No comments:
Post a Comment