রঞ্জনরশ্মিঃ রঞ্জন মৈত্র

পাঠকামি -১



বই কিনি, বই পড়ি, একটা দুটো কাছে পিঠে রাখি । দিল্লিতে বেশ কয়েকটি বাংলা বইয়ের দোকান আছে, বছরে একবার বাংলা বইমেলাও হয় । কিন্তু বইমেলা নিয়ে অনেকদিন ধরে পরিষ্কার কোন ছবি আঁকতে পারছিলাম না, এটা স্বাভাবিকই, বৃহত্তর কলকাতা বইমেলার আবেগের সাথে পরিচিত ছিলাম না । মেলা বলতে শুধু বই কেনা বেচা দেখে এসেছি । তার সাথে জড়িত কবি, সাহিত্যিক, প্রকাশকদের একাত্মা হয়ে যাওয়া, পাঠকের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া,মেলা শেষের ঘণ্টা ধ্বনির সাথে চোখের জল মিশিয়ে দেওয়া ব্যাপারটা অনুভব করলাম এবার । কলকাতা বইমেলা থেকে ফিরে এলাম অনেকগুলি স্মৃতি ও বই সংগ্রহ করে ।


বেশীর ভাগ বইই পড়া হয়ে ওঠেনি, এক একটা বই হাতে নিচ্ছি, দু পাতা পড়ার পরে অফিসের কাজগুলি এমন ভাবে হুমড়ি খেয়ে এসে পড়ে! আজকাল খুব কাজের চাপ, বহুজাতিক এই সব কোম্পানির উদারতায় আমরা বিশ্ববাজারে পণ্য হয়ে যাচ্ছি, আজকাল লোকে আমাদের নিয়ে কবিতাও লিখছে । পণ্য হয়ে থাকতে খারাপ লাগে না, তবে একটু শিল্পের স্বাদ পেলেও খারাপ হয় না, সুতরাং আবার একটা বই হাতে তুলে নিই ।



বই: রঞ্জনরশ্মি – রঞ্জন মৈত্র

কলকাতা বইমেলায় এইবার প্রথম । নতুন কবিতার স্টলে যখন ঢুকলাম, সবই অচেনা মুখ । ভাস্বতী দি পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন ইনি প্রদীপ, ইনি সব্যসাচী, ইনি প্রশান্ত দা, ইনি রঞ্জন দা ...এক নজরে মনে হল, রঞ্জন দা কে আগে কোথাও দেখেছি । একটু ভেবে নিলাম, কোথায় ? নাহ, কোথাও দেখিনি তো ? রঞ্জনরশ্মি বইটা হাতে নিয়ে ভাস্বতী দি বলছিলো, এটাই আমাদের বাইবেল, সংগে সংগে বইটা আমি কিনে নিলাম । রঞ্জন বোধহয় আমাকে  ভাস্বতী দির কাছে শুনে শুনে আমাকে চিনে নিয়েছেন, আমাকে একটা বই ‘কলোকাল ট্রেন’ সাথে সাথে উপহার ও দিলেন । মেলা শেষে ফিরে এসেছি দিল্লিতে, অনেক বড় বড় কবিদের সাথে পরিচয়ের স্মৃতি ফিকে হয়ে আসেনি । কিন্তু আমারই ব্যর্থতা , আমি সময় করে তাদের বই পড়ে মতামত ও জানিয়ে উঠতে পারিনি ...   

তবে, আজ হাতে নিয়ে একরাশ রঞ্জন, আলো উপচিয়ে পড়ছে সারা ঘর, ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রশ্মির ছাঁট, পড়ছি ‘আমার আজান’ ।

‘খাটের তলায় জমে যাচ্ছে রোদ / এবার বেচে দেবো কিছুটা করে’

‘আলোক পিপাসু’ থেকে ......

বানভাসি/ঘৃণা ও মমতা, সম্পর্কহীনতার দিকে ভেসে/যায় ইমনকল্যান, নেভানো শ্মশান তাই ঝাপসা বড়ো ঝাপসা হয়ে যায় ।

ভাবছি কবেকার লেখা ? ১৯৮৮ সালের দিকে হবে হয়তো, কি দারুণ পরিপক্বতা, রঞ্জন দার এই লেখাগুলির আজও আকর্ষনক্ষমতা হারায় নি, আজও তা আপেক্ষিক ও প্রাসঙ্গিক ।

‘সুবর্ণ রেখা রানওয়ে’ অনেক আলোচিত বই, আমি আগে কখনো পড়িনি । তার জন্য কবি বা কবিতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়না, আমি অনেক পরে এই পড়া ব্যাপারটায় এসেছি । তাই শেষের পাতাগুলি থেকে পড়া শুরু করলাম, চোখ আটকে গেল ‘জলছুট’ কবিতায়-

‘উপরে তাকাই, ময়লা প্লাস্টিক, পায়ের দিক থেকে প্লাস্টিক হয়ে উঠেছে...কবে সবুজ দেবার কথা দানা কথা হবে কোঠা ও ক্যানেলে’

এখানে ‘দানা’ কথাটা আমি এই যুগে বসে একটু ভাবছি, আমরা কি মেইন মুদ্দা থেকে হারিয়ে যাচ্ছি ? আরও অনেক কবিতা ভালো লেগেছে, ‘ঝাঁঝার চেয়েও’, ’স্ক্রু’, ‘মনসুন’, ’আমার মোরগ’, ’অনুবাদে উদ্বাস্তু দিন’, ’মেরুপাখি’, ’পিকনিক’ ,আরও, আরও অনেক কবিতা ।

‘সেভেন বেলোর বাড়ি’ এই কিছুদিন আগে শুনলাম এক বন্ধু নীলাব্জের কাছে, পরে জানতে পারলাম এটা আবার রঞ্জনরশ্মির বইয়ের মধ্যেই আছে ।সুতরাং একটু আলাদা উৎসাহ অনুভব করছি, এক্সাক্টলি...

‘প্রাণ’ থেকে

‘এক মুঠো আঙুল থেকে ফস্কে যায়/পালকের সম্ভাবনাগুলো’

এরকম একটা ভাবনা হঠাৎই আসে...কিন্ত কাঁকতলিয় ভাবে কখনোই আসে না, কলমের আশে পাশে তার হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায় আর রঞ্জনদার মাপের কবিরা তাকে লিখে ফেলে । ওরা কলম থেকে আবার পালক হয়ে যায় । ওরা প্রাণ পায় । পড়ছি ‘সুইমিং পুল’

‘ঝাঁপিয়ে পড়ছে রঙ্গিন মাটিরা সারশোয়া ছায়ার/ উপর । গ্লুকন সরোবরের পাশে চোখে অফসেট সকাল’

এ যেন আমারই জীবন যাত্রার ,দিন কখন যে দুপুর হয় আমার পাকস্থলী এখনো ঠিক করে উঠতে পারেনি । যেটা টের পায় প্যান-ডি জাতীয় পেন্টাপ্রাজল গুলো ।  আরও বেশ কয়েকটি কবিতা উল্লেখ করা যায় যেমন ‘অনুরোধের আসর’, ‘সিলেবাস’,’শ্রীলার রান্নাঘর’, ‘পক্ষী নিবাস’, তাতে শুধু তালিকা বাড়ে, আর আসলে তালিকা টা অনেক লম্বা । মোটামুটি নীলাব্জের সাথে একমত, ‘সেভেন বেলোর বাড়ি’ আমার কাছে সেরা মনে হয়েছে ।

‘কলোকাল ট্রেন’ –তাহলে আমার কাছে দুটি কপি হলো ।রঞ্জনদা একটা আমাকে উপহার হিসাবে দিয়েছেন আর একটা এই বইয়ের মধ্যেই । কিন্তু এবার ব্যাপারটা আরও ধোঁয়াশা হোল, রঞ্জনদা জানতেন যে রঞ্জনরশ্মি বইটায় ‘কলোকাল ট্রেন’ বইটা ইনক্লুডেড আছে, তবু কেন এই বইটাই আমাকে দিলেন ? নাকি এটা তার প্রিয় বই ? যা হোক, খুলে দেখি...

‘দরবারী’

কবিতাটার নামকরণ দেখেই তরবারির কথাটা মনে এলো, শিরোচ্ছেদ কথাটাও । এই প্রসঙ্গে আরও একটা কথা মনে এলো তা হোল, আমার বড়দা পলাশকান্তি বিশ্বাস রঞ্জন দার পূর্ব-পরিচিত । বড়দা যে দিন আমার সাথে দেখা করতে বইমেলাতে আসেন, সেদিন আমার সাথে রঞ্জনদা কে দেখে অবাক, রঞ্জন দাও পলাশদা কে দেখে অবাক । আমি বড়দা কে জিজ্ঞেস করলাম , চেন নাকি ? দাদা বললেন, ‘হ্যাঁ- উনি তো কঠিন লেখার মাস্টার’... না এবার বেঁচে গেলাম । ট্রেন থেকে নেমে এলো সহজ ভাষার ভিড়, আর সবুজ তরি-তরকারি, সাধারণ মানুষদের প্রতিদিনের কথা দিয়ে সাজানো এক অমায়িক কবিতা । এই ‘দরবারি’ কবিতা থেকে

‘সুঁই থেকে সিরাম থেকে বেরিয়ে আবার শূন্যতটে/ হাতুড়ির গানটুকু একা হেঁটে যায়...’

বাকি বইটা এমনি তে বোঝা হয়ে যায়, ভালো । সত্যি তো, এই বইটি দু বারই পড়া যায় ।



‘আলোতোয়া অডিও মঞ্জরী’ আর একটা বই, এটা বোধহয় লেটেস্ট! দেখে নিই ‘উৎসার’

‘গলা প্যাস্টেল থেকে / ছিটকে ওঠে পাথর / ক্রমে আলোরূহ আলোঝরা / হাতঘড়ির অচেনা সি-শার্প’

এ যেন টিক টিক শব্দে বয়ে চলা জীবনগতি ; আমাদের আশেপাশে ঘিরে রয়েছে । ছবিগুলি ছায়াছবির মত ! কল্পনা মিশিয়ে শুরু হয়, বাস্তবের স্পর্শ দিয়ে শেষ হয়, কিংবা কখনো শেষ হয় না ।

‘কথার ঢালুতে এই ডাক হরতাল /এ ভাবে মহিম হয়ে যায়...।লাগোয়া পুকুর ফুঁড়ে সূর্য ওঠে/ ওড়া ছাই ভেঙে ওড়ে শুকনালি/ঠোট ভেঙে হু হু নামে ঘাস ও ভেড়ারা’ ।



সুতরাং এইখানে শেষ হইয়াও হইলোনা শেষ, আবার আসব অন্য কোন পাঠের নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে ।

No comments:

Post a Comment