হাইফেন বসানো বারান্দাঃ বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

পাঠকামি - ১৫

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে আমার আগের পরিচয় নেই । বইমেলায় কোনদিন দেখা হয়েছিল হয়তো কিংবা হয়নি কেউ মনে রেখেছে বা কেউ রাখেনি । বিস্তারিত ভাবে ফেসবুকে পরিচয়, এমন একটা দুনিয়া যেখানে আপনি যদি ঢাক না বাজান মুখ ঢাকা পরে যায় । কোন বিজ্ঞাপনই আর কাজে আসে না । মানুষ তবুও একটা বারান্দা খোঁজে, যেখানে বসে দুটো কথা বলা যায়, একটা দুটো প্রতুত্তর , কতক্ষন আর একাকীত্বে আটকে থাকা যায়, কখনো কখনো একটা হাইফেন এখানে বসিয়ে শূন্যস্থান পুরন করার কথা ভাবি ।

হাইফেন বসানো বারান্দা ঃ বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
দু একটা কবিতা বিপ্লবদার পড়িনি সে রকম নয়, পাঠের মধ্যেও তেমন পরিচয় থাকে না , কবির সম্পর্কে জানার জন্য একটা দুটো কবিতা কাফি নয়, কিন্তু এক ঝলকে এটা বোঝা যায় আর একটু গভীরে জানা যায় কিনা, ভিতর যানা চাহিয়ে । এই বইটি আমি কুরিয়ারে পাই ।

"এক পশলা গ্রামজীবন ।
লম্ফ জ্বেলে কেবলই অপেক্ষা করে   রাত " - স্থানীয় ছায়া এবং

কবিতাটি আমি আমার প্রেক্ষাপটে পড়ি । গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে আস আলো আজ অন্ধকার কাটানোর কথা বলেন কবি । একটা অন্ধকার কাটানোর জন্য একটা ল্যম্পই যথেষ্ট । অল্প প্রয়াস, সে আলোয় কিন্তু দিব্বি দেখা যায় ।  একটা রাত আসে তার পর , খানিকটা গ্যাপ দিয়ে, তখন বোধহয় সব লম্ফরা ঘুমাতে যায়, গ্রাম জেগে থাকে...শহর বোধ হয় গ্রাম কে মুছে দিতে পারে না,  বহু শতাব্দী ধরে গ্রাম জেগে আছে ।

"মরচে ধরার ভয়ে
গোপন পেরেক ক্ষত   সম্পাদনাহীন " - মধ্যাকর্ষণ

বেশ কিছু বছর হলো কবিতা পড়ায় মন দিয়েছি । বিজ্ঞরা বলেন যেন,  কবি নিজেই এক একটা বিষয় । সুতরাং কবি নিজেকে নিয়েই লিখবেন । তাই নিজেকে শান দিতে চান যে কোন কবি, সে এত তাড়াতাড়িই আউটডেটেড হইয়ে যেতে চায় না, যে কোন ভাবে মেলে ধরতে চায় প্রতিভা । বিপ্লব দা লেখেন যে,  প্রচার কৌশল বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে ।  কবিরা মেতে ওঠে 'আমরা' 'ওদের' খেলায় । কিন্তু আদতে তারা কবি হতেই চেয়েছিলো , এখানেও একটা গ্যাপ দিয়ে কবি কথাটা বলেন, গ্যাপটা একটা বিরতি । তার বোধোদয় মনে হয় একটা ব্রেকের পরে আসে ।

"গোলকত্ব আর ঝর্ণাজলের নিশ্চয়তা
থেকে চুরি হয়ে যাচ্ছে  প্রাসঙ্গিক জিজ্ঞাসাবাদ
মাঠ থেকে গড়িয়ে যাচ্ছে ফুটবল" - ঝর্ণাজলের নিশ্চয়তা

এমন একটা বিষয়, প্রশ্ন না ওঠাই স্বাভাবিক । যে বল গড়িয়ে যায় তার আয়তন নিয়ে কে আর ভাবে, বলটা কিভাবে গোল হয়ে যায় ? মাঠ থেকে দৃশ্য মুলত উধাও । একটা পৃষ্ঠ টানে জলের এক একটা বিন্দু টপ টপ করে পরে, সে কি আয়তন নেয় ? আর একটা প্রশ্ন উসকে দেয় অন্যের কোর্টে বলটা আমরা ফেলছি না অবিরাম ? কবিতাগুলো কবির মুখ হয়ে উঠেছে ।

"বাইদ বহাল । কৃষিজমি । উঠোন পেরিয়ে
দূ রে লাঙলের ধারালো ইস্পাত ।
ছুড়ে গেলে আগাছা জঞ্জাল । সবুজ ব্রা
নুন গন্ধ । সুঠাম মাঠ । আধখোলা মাঠ । " স্নাতকের লিরিক্যাল হাত

এটাই এই বইয়ের সেরা কবিতা মনে হলো । কবিতা লিখতে গিয়ে দেখেছি এক জন্মের ইচ্ছা কেমন চাষ আবাদের কথা বলে । সৃষ্টির আগ্রহ পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যায়, তার চোখে যা কিছু প্রিয়, যা কিছু আপনা, বড়ো কোমলও আদরনীয় মনে হয় । মনে হয় কে যেন ডাকছে প্রতিদিন, মাঠ শুয়ে থাকে, শুধু ঝাপিয়ে পড়ার আমন্ত্রন, একটা ইশারার অপেক্ষায় থাকে । ভিজে উঠতে চায় যে কোন কবি, যে কোন পাঠক । কবির আশাবাদক দৃষ্টিভঙ্গি কাব্য-দর্শন কে দৃঢ়তা দেয় ।

"এক সময় আলো এসে পড়ে
কথা বলতে বলতে থেকে যায় ঝাপসা দৃষ্টি
সহজ মুদ্রায় কিছু সোনালী বিভ্রম
ঝুল জমতেই থাকে
    জমতেই থাকে " - হাইফেন বসানো বারান্দা

এ রকম অনেক কবিতা পড়ি । কবিতা পড়িয়ে নেয় । এক নতুন শৈলী আছে । বোঝার আছে । ভাবনার আছে । কতকিছু আমাদের টানে, কবি তার সাথে আমাদের যোগাযোগ করিয়ে দেন , নিমগ্ন পাঠের ভিতর ডুবিয়ে দিতে বলেন মন ।  নিজেকে ধুয়ে মুছে আবার দাঁড় করিয়ে নেয় কবি , আয়নায় দেখতে পান , আমাদের দেখান , বুকের ভিতর ঝেঁকে দেখতে ইচ্ছা করে আবার ।

আরো অনেক কবিতা পড়া যায়, এপিসোড, খেলাঘর , আকাশ ক্যাম্পাস, অসুখের রাফখাতা, আলো-টোন, রাতের কার্তুজ, অলীক বাইপাস । কবিতাগুলি পড়ে মনে হয়, কবি তার অভিজ্ঞতার এক সিরিয়াস ঝুলি পাঠকের দরবারে উন্মুক্ত করে দিয়েছে । এক নতুন কবিতা উপস্থাপন করে চলেছে । বিপ্লবদার হাতে আরো কিছু অচেনা মানুষের কথা, যাপনের দিন রাত্রির কথা উঠে আসুক, উদ্ভাষিত করুক কবিতাকে যা নিয়ে এ রকম আরো অনেক নিরীক্ষা স্থায়িত্ব পাক , কবিতা কথা বলে উঠুক ।














 

No comments:

Post a Comment