ঈভ, একটি ডালিমখেতের বিজ্ঞাপনঃ দোলনচাঁপা চক্রবর্তী

পাঠকামি-৩

বই পড়ার তেমন নেশা ছিলো না, বাড়িতে বড়দার খুব সখ ছিলো বই সংগ্রহ করা এনে দিত । মাঝে মাঝে বাচ্চাদের বই, কমিক্স, শুকতারা, এই সব পড়তাম । পয়সার টানাটানি থাকাতে বড়দা শারদীয় সংখ্যাগুলি বেশী সংগ্রহ করতেন, বলতেন, সস্তায় অনেকগুলো উপন্যাস একসাথে পাওয়া যায় । সেভেন এইটে এইগুলো পড়তাম পালা করে । দাদা পাঠ করে শোনাত জীবনানন্দের কবিতা , বুদ্ধদেব বসুর কবিতা । তারপর যখন মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, এই বইগুলি থেকে নিজেকে অনেকটা দূরে আবিষ্কার করলাম একদিন । দেখি, কর্মজীবনে এই সবের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে । তারপর বহুদিন কেটে গেছে । কারো বই, কবিতা তেমন আর পড়ি না । পড়ার ইচ্ছে থাকে, কিন্তু পড়ি না, কর্মসূত্রে দূর দূরান্তে থাকায়, আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি । এভাবেই চলতে তাহকে, চলতে চলতে কালক্রমে ইন্টারনেটের কাছে আসি একদিন, খুঁজতে থাকি যদি কিছু বই ডাউনলোড করা যায় । একটা দুটো ব্লগ নজরে আসে । পড়ি । এভাবেই নেটিজেন হয়ে অনেকদিন, তারপর ফেসবুক , বই পড়ার ইচ্ছাটা আবার জেগে ওঠে । কিন্তু বই কোথায় ?  বইয়ের জন্য অনলাইনই ভরষা এখন ।
একদিন নেটেই খুঁজতে খুঁজতে আবিষ্কার করলাম , বুকপকেট । ঘরের কাছে আরশীনগর । ফেসবুকের খোজাখুঁজি করে বোঝা গেল, অনেক শক্তিশালী ব্যক্তিত্য এর সাথে জড়িয়ে আছে । পিং করলাম, যোগাযোগ হলো, পরিচয় হলো দোলনচাঁপা চক্রবর্তীর সাথে । তার কবিতা আলোচনা , প্রত্রিকা সম্পাদনা আগেই দেখেছি, তার নতুন কবিতার বই ‘ঈভ, একটি ডালিমখেতের বিজ্ঞাপন’ এর বিজ্ঞাপনও দেখতে পেলাম ফেসবুকে ।
এমনই এক ক্ষনে এবছর কলকাতা বইমেলায় কৌরবের স্টলে দেখা হলো কবি দোলনচাঁপা চক্রবর্তীর সাথে, মিতভাষী, শান্ত, উজ্জল ব্যক্তিত্য ; বইটি দিলেন আমাকে, লিখে দিলেন ‘পীযুষ কে’ । আমি বল্লাম একটা বিল কেটে দিনজবাবে বল্লেন, ‘আমি তো পয়সার জন্য কবিতা লিখি না’, বুঝতে পারলাম, কবিতার মধ্যে তিনি কতখানি জমি করে রেখেছেন, কতটা পা ডুবিয়ে রাখলে এমন ডালিমের খেত করা যায় । এমন মানুষের কবিতার আলাদা স্বাদ থাকবেই, বইটা খোলা যাক ।
বইঃ ঈভ, একটি ডালিমখেতের বিজ্ঞাপন – দোলনচাঁপা চক্রবর্তী

এই বইমেলায় আমি অনেক বই সংগ্রহ করেছি, এটাই এ পর্য্যন্ত শ্রেষ্ঠ প্রচ্ছদ বলে মনে হয়েছে, তেমন হয়েছে বইয়ের বাঁধুনি । যদিও এই ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা খুব কম, তবুও বলব, রঙের ব্যবহার কবির মুখচ্ছবিকে মনে করিয়ে দেয় । এই বইটি পাতার পর পাতা সিরিয়ালি না পড়ে আমি মাঝখান থেকে পড়ব
‘ভাঙা মাস্তুল’
নামটা শুনে জাহাজের কথা মনে পড়ে, বেশকিছু জাহাজের কবিতা আমি পাবলো নেরুদার পড়েছি । অদ্ভুত আবেশ তৈরী হয়, রহস্যময় করে তোলেন উনি । এখানে সম্পর্কের কথা । জলের মত । প্রতিদিনকার মত বয়ে চলে, ভ্রুক্ষেপ নেই কারো, কারো জন্য কেউ দাঁড়ায় না ।
‘অথচ জলকে ডাক দিতে দিতে পিছিয়ে যাচ্ছে বাইচের দাঁড়;’  এভাবেই আমারও আর একটা দিন চলে গেল ।
‘রবার গাছের স্মৃতি’
কবিতাটিতে ইলাস্টিসিটি লক্ষ্য করছি, টেনে একবার ছেড়ে দিলে আবার নিজের যায়গায় ফিরে যায় । ফিজিক্সের সূত্রের মত কবি সম্পর্কের আরো একটি সূত্র তুলে ধরছেন কিভাবে জল গড়িয়ে নীচের দিকে যায় । যেতে বাধ্য হয় । মন চায় না, তবু যেতে হয়, যেতে যেতে নানা স্মৃতি উঠে চলে আসে, নারী জীবনের বিভিন্ন বাঁকে এসে সম্পর্কগুলো প্রশ্ন তুলে ধরে, কিন্তু কবি এই প্রশ্নে বিচলিত হয় না । দেখেছি এ যুগের আরো কিছু মহিলা কবিদের মধ্যে যেখানে আবেগটা প্রধান, ব্যথা পেলে কেঁদে ফেলেন । কাঁদাটা স্বাভাবিক, কিন্তু ব্যথাটাও স্বাভাবিক, অন্ততঃ ব্যথার একটা সূত্র আছে, এই রবার গাছের স্মৃতিতে সেই বিশ্লেষনটা আমি দেখলাম ।
আর একটা মজার কবিতা হলো ‘দারুহরিদ্রা’
‘উলের নকশা বুঝে তারা গর্ভিণী হবে । তন্তু দাও, শ্রীও দিতে পারো তাকে, বড়ো ভালো হয় সামান্য কলংক যদি দাও’ 
বারুদের ভাষা মিঠা লাগে বড়, ভালোবাস হয়ে যায় । ভয় হয়, তবু ভালো লাগে, গা ছম ছম, বড়ো ভালো লাগে । কবি বলেন
‘সমস্ত ল থেকে জল তুলে নিতে নিতে হিমসিম কুয়ো, আলোর প্রতিচ্ছবি উড়ে যাওয়া পাখালিতে, ডালিমদানায়’
কি হয়, কি হয় । কি জানি কি হয় ।
এই বার প্রথম কবিতায় আসি, ‘কথকতা’, একনজরে বুঝতে পারি, দোলনচাঁপার কবিতা যেখান খুশী, সেখান থেকে পড়া যায় , আজকের দিনে যে সমস্ত কবিদের কবিতা পড়ি, মাইরি বলছি, এমন রোমাঞ্চকর দানাবাঁধা কবিতা কম পড়েছি...প্রতিটা লাইন কোট করা যায় । আমি বিশেষ করে লক্ষ্য করছি কবি এত স্মুথ জার্নি কি করে করে, সমতলে বয়ে যাওয়া একনদীর মত, কিন্ত তার ভাষা আলাদা, চলন আলাদা, স্থান কাল পাত্র আলাদা । বিশেষ বিষয় তার নেই, কিন্তু অনেক কিছুকে স্পর্শ করে । আমি মাঝে মাঝে একটা যাদুও দেখতে পাই ।
‘যারা কামানের সামনে থেকে, তুষারপিন্ডের শীতলতা থেকে পালিয়ে এসেছে মায়ের কাছে...’
এক বিপ্রতীপ খন্ডযুদ্ধের অমায়িক দ্যোতনা । এরকম আরো বেশ কয়েকজন কবিকে শব্দকে বিষয়ের সাথে মিশ্রিত করে দারুন ধ্বনি তৈরী করে , কানে এসেই শুধু লাগে না, প্রানে এসেও লাগে । কি জানি আধুনিকতার এই রুপকে ভালো বাংলায় কি বলে ।
‘দেশলাইবাতির ঘর’- আগুন কে বুকে করে কাঠ পড়ে আছে, জলের কাছে,...এক দুফোটা ঘি বর্তমান, বালক-ব্রম্মচারী ভোল পালটে কিভাবে জল কে দূষিত করতে পারে , সেই ভাবনা তার মাথায়, নারী সব জানে, কবিও ।
‘দূর হতে শষ্যমাদুর’ – একটা সমুদ্র দেখতে পাচ্ছি, সবুজের । অন্ততঃ এতদূর দিল্লি থেকে তো তাই মনে হয় ।
‘বিষাদের মুখোমুখি পার্পল শাখাগুলো খুলে যায়/তোমাকে জড়িয়ে রাখা ল্যাভেন্ডার/রোদ হচ্ছে অচেনা হচ্ছে ঘুমের মরসুমে’
কিংবা
‘এই অতলে নদীকে নামাব কি করে/নাব্যতা দেখবার যন্ত্রনাগুলি কাছে নেই’
ব্যাপারটা কোন ব্যাপার না, বিষয়টা কোন বিষয় না, এক গোল বৃত্তের মধ্যে আটকে থাকা জ্যা, শব্দের জাদুটোনায় কি করে বুকের মাংসল ফাঁকে কবিতা হয়ে যায় । কবি দোলনচাঁপা সেটাই করে দেখালেন ।


‘গোলাপি কামিজের খামার বাড়ি’ – খুঁজে পাচ্ছি মাটি , জলের নিদারুন সম্পর্ক, কবি গুছিয়ে লিখে চলেছেন তার কবিতা যাত্রা । হয়তো তার একটি ইগলু আছে, তারই খোঁজ চলছে । দৃশ্য রচনা, মননের পূর্ণ ব্যবহার, অবচেতন মনের প্রতিচ্ছবি, কি জানি এর কোন গালভরা নাম আছে কিনা, আমি বলব, এত সাত প্যাচে গিয়ে লাভ কি, প্রত্যেক কোম্পানীর ম্যানেজার আলাদা । ভালো লাগলো তাই আরো পড়ার অপেক্ষায় আছি । 

No comments:

Post a Comment