নীরব পর্যবেক্ষক: মাহমুদ নোমান এবং দৈনন্দিন বাংলাদেশের কবিতা
একটি সুন্দর কবিতা লেখার আগে দরকার একটি সুন্দর পাঠ । একটি সুন্দর হয়ে ওঠার আগে দরকার একটি মুখ । সততার মুখ, বাংলার মুখ । যেহেতু কবিতা লিখি, পত্রিকা করি , তো সেই হিসাবে কিছু কবির সঙ্গে দেখা হয়ে যায় । অনেক সময় বুঝতে পারিনা কবি, সত্যই কবি কিনা, নাকি দরবেশ । নাকি আশি পাতা লিখে ফেলা লুইজাল ।
একসময় পাঠকামি করতাম, অর্থাৎ আমি নিজেকে আমি আগে পাঠক মনে করি । ঐটাই আমি । পাঠ নিয়ে পাকামি করতাম । কবিতা জ্ঞানের বাইরে পড়ি বলে 'রিভিউ' লেখার মতো জায়গায় ছিলাম না । বরং আজ একটি গ্রন্থ পাঠ করে, সেই সম্পর্কে জানাই । গ্রন্থটির নাম লুইজালে, কবি মাহমুদ নোমান ।
প্রথমে তার একটি কবিতা রাখি, তারপর তার বিশেষ্য । অব্যয় ক্রিয়া পরবর্তীতে ।
"আমি প্রতিদিন দুঃখকে জ্বালাই / আগরবাতির মতো/
..........
/কিংবা কাঁদতে খুব ইচ্ছে হলে / আগরবাতির শরণাপন্ন হই--
বুক চাপড়ানো দুঃখগুলো / আগরবাতির সুগন্ধিতে জিকির করে /
আমার রওজার চতুর্দিকে "
(আগরবাতির কাস্টমর)
আজকালের ডবল ধামাকার বাজারে মোড়কের বিকিকিনি থেকে দূরে আগরবাতির স্থান, তার গা অমলিন, তার গন্ধ উগ্র, কিন্তু এখানেই মানুষের আসা যাওয়া । এটাই যাপনচিত্রের শিকড় । প্রান্তিক মানুষের কাছে আলোক সজ্জার থেকে অধিক প্রিয় তার নৈকট্য , আগরবাতির কাছে তার বারবার ফিরে আসা । যার কাছে এসে নিজেকে সমর্পণ করা যায় ।
চট্টগ্রামের প্রাণবন্ত সাহিত্যিক প্রেক্ষাপটে, একটি নাম নীরব কিন্তু দৃঢ় শক্তির সাথে অনুরণিত হতে শুরু করেছে: মাহমুদ নোমান। তিনি কোনো মহান ঘোষণা বা বিস্তৃত আখ্যানের কবি নন, বরং জীবনের সূক্ষ্ম ছন্দের একজন গভীর পর্যবেক্ষক, প্রায়শই ভিড়ের মধ্যে দেখা যায়, যেন ধ্যানমগ্ন হয়ে তিনি জগতকে আত্মস্থ করছেন। নোমানের কবিতা সংকলন "লুই জালে" তাঁর অনন্য কাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি জানালা খুলে দেয়, যা ছোট মুহূর্তগুলির শক্তি এবং সেগুলির মধ্যে থাকা গভীর আবেগগুলির প্রমাণ।
নোমানের শক্তি নিহিত তাঁর আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ বিষয়গুলোকে আলোকিত করার ক্ষমতার মধ্যে। তিনি অতি সাধারণের মাঝে কবিতা খুঁজে পান, দৈনন্দিন জীবনের ছোট, প্রায়শই উপেক্ষিত বিবরণগুলির উপর তাঁর মনোযোগ দেন। একটি মিটমিট করে জ্বলা বাতি, চায়ের দোকানের কাপের পুরনো প্রান্ত, ধুলোতে খেলা করা একটি শিশু - এগুলোই নোমানের কাব্যিক আখ্যানের ক্যানভাস হয়ে ওঠে। এই নিবিষ্ট মনোযোগ, যা গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অর্জিত, তাঁকে এই সরল মুহূর্তগুলোতে এমন গভীরতা এবং অনুরণন দিতে সাহায্য করে যা একই সাথে আশ্চর্যজনক এবং হৃদয়স্পর্শী।
"ধানপাতায় জমে থাকা বাসি শিশিরে / তাকিয়ে দেখি । সূর্য নগ্ন ! /
ফের তোমাতে তাকিয়ে দেখি / তুমিও বিষণ্ণতার জ্যামিতি আঁকছো /
তোমার মেয়ের অঙ্কের খাতায় । / ভাবছি, গতরাতে ঘুমের ঔষধটি কি খেলাম ।"
(নস্টালজিক রোদে )
মাটির মানুষ, কবি মাহমুদ নোমান । নিজের লিমিটেশন জানেন । কোন প্রথাগত কবিবিদ্যা , কবিসঙ্গ, কবিগুরু ছাড়াই তার কবিতা অভ্যাস । নিজের থেকে শেখা ভাষা থেকেই তার কবিতা জন্ম । নিজে কখনো হয়ে ওঠেন আত্মবিশ্বাসী আবার কখনো বা আত্মদ্বন্দে হয়ে যান পাগল পারা । নিজের বৃত্তে , পল্লি পরিবেশে আত্মহারা হয়ে ওঠেন ।
সাধারণ পটভূমি থেকে উঠে আসা নোমান, সাধারণ বাংলাদেশিদের জীবনে আনন্দ এবং দুঃখের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে গভীর ধারণা রাখেন। তাঁর কবিতা এই গভীর সহানুভূতিকে প্রতিফলিত করে, যা তাঁর সম্প্রদায়ের সংগ্রাম এবং উদযাপনের অভিজ্ঞতার একটি মর্মস্পর্শী চিত্র তুলে ধরে। তিনি দারিদ্র্যের চাপ বোঝেন, কিন্তু একই সাথে দৈনন্দিন জীবনের গভীরে থাকা স্থিতিস্থাপক চেতনা এবং অদম্য আশাকেও অনুভব করেন। এই অভিজ্ঞতা ও সত্যতা তাঁর কাজকে একটি অনন্য শক্তি দেয়, যা তাঁর কণ্ঠস্বরকে একই সাথে আকর্ষণীয় এবং সম্পর্কিত করে তোলে।
তাঁর দক্ষতা কেবল কী নিয়ে লিখছেন তাতেই সীমাবদ্ধ নয়, তিনি কীভাবে তা প্রকাশ করেন তার মধ্যেও নিহিত। নোমানের শব্দ নির্বাচন সুনির্দিষ্ট এবং উদ্দেশ্য পূর্ণ, প্রতিটি শব্দ সঠিক মেজাজ এবং চিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্য যত্ন সহকারে নির্বাচিত। তিনি অলঙ্কৃত ভাষা বা জটিল নির্মাণের উপর নির্ভর করেন না, বরং একটি সরলতা এবং স্পষ্টতাকে পছন্দ করেন যা বিষয়টিকে উজ্জ্বল করে তোলে। তাঁর রূপকের উদ্ভাবনী শক্তির সাথে মিলিত এই স্বচ্ছ প্রকাশ তাঁর কবিতাকে সহজলভ্য এবং গভীরভাবে প্রভাবশালী করে তোলে।
নোমান একজন তরুণ, সতেজ কণ্ঠস্বর, যা সমসাময়িক বাংলাদেশী কবিতার জগতে একটি প্রয়োজনীয় সরলতা এবং অনন্য চিন্তাধারা নিয়ে আসে। তাঁর কবিতাগুলি তাঁর আদি গ্রামের সারমর্ম দিয়ে পরিপূর্ণ। গ্রামীণ দৃশ্য থেকে নেওয়া ছবিগুলি - পুকুরে লাফানো মাছ, ধুলোময় গ্রামের রাস্তা, ধানক্ষেত এবং নদীর বুকে নৌকার ছন্দময় চলাচল - নোমানের কবিতা পাঠককে গ্রামের জীবনের হৃদয়ে পৌঁছে দেয়। তিনি গ্রামীণ জীবনের এই উপাদানগুলির সাথে আধুনিক শহুরে জীবনের সংগ্রামের সুন্দর তুলনা করেন, যেখানে বিচ্ছিন্নতা, অর্থ দিয়ে পূরণ করা যায় না এমন শূন্যতা এবং জীবনের ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতির গভীর উপলব্ধি প্রকাশ পায়। যখন একটি জীবন আর থাকে না, তখন সমস্ত অর্থ এবং বস্তুগত সম্পদ আত্মা বা দেহের জন্য কোনো কাজে আসে না।
"লুই জালে" কেবল কবিতার একটি সংগ্রহ নয়; এটি গল্পের একটি উপহার, জীবনের সাধারণ সৌন্দর্য এবং গভীর জটিলতার প্রতিফলন। মাহমুদ নোমান, মানুষের কবি, আমাদের মনে করিয়ে দেন যে প্রকৃত কবিতা অসাধারণত্বের মধ্যে নয়, বরং সাধারণের মধ্যে অসাধারণত্ব দেখার ক্ষমতার মধ্যেই নিহিত।
তার কবিতা আমাদের জানান দেয় যে জীবন প্রকৃতপক্ষে কোন ধরনের সম্পদ ও অর্থহীন অবস্থায়ও সুন্দর হতে পারে, এবং এই কারণেই তার লেখার প্রতিটি শব্দ গাঢ় এবং যথোপযুক্ত হয়। তিনি তার কবিতার মাধ্যমে আমাদের জীবনের সত্যিকারের সারমর্ম তুলে ধরেন এবং আমাদের চিন্তাভাবনা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেয়।
"লুই জালে" মাহমুদ নোমানের অসাধারণ প্রতিভার আরেকটি দৃষ্টান্ত, যেখানে তিনি গ্রামীণ জীবন এবং আধুনিক জীবনের মধ্যে একটি অনন্য সংযোগ স্থাপন করেছেন, যা পাঠকদের মুগ্ধ এবং চিন্তাশীল করে তোলে। এই হলো তার অব্যয়, এই হলো তার বিশেষণ । ক্রিয়াপদ তার কবিতায় কিছুকাল বর্জিত থাকুক ।
No comments:
Post a Comment