Sunday, May 20, 2018

পাঠকামি-২৫ জ্ঞানেন্দ্রগীতি


পাঠকামির অনেক সংখ্যা হল - গদ্য পদ্য প্রবন্ধ । রক্ত, মজ্জায়, ধমনিতে যে পাঠ দশক দশক ধরে জমা আছে, তা লেখা হয় নাই । পাঠ আসলে একটা ক্রমাগত যাপনপদ্ধতি, যার কোন ঊষা নেই, যার কোন অন্তিম নেই । এই বয়ে যাওয়া মুহূর্ত,  এই এতটুকু সময়ের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে যা কিছু পাঠ্য , আমি যাকে পাঠকামি বলি, আর তা কেবল নিজের শিল্পবোধ, মনন, দেখে,  শুনে,  বুঝে, ও ঠেকে শেখা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই । নিজেকে উলটে দিই,  পাঠ্যকে ঋজু করি,  বোঝাপড়া, টানাপড়েন, গদ্য, পদ্য, অন্ত্যমিল নিয়ে আমি যা কিছু বুঝি । নিয়মিত-অনিয়মিত অনেক বই পড়ে থাকি , আজ পড়ছি একটা বিশেষ গ্রন্থ , নামঃজ্ঞানেন্দ্রগীতি । জ্ঞানেন্দ্রনাথ বিশ্বাস আমার স্বর্গীয় পিতা,  তার অল্পকিছু গান সংকলিত হয়ে এই বইটি উবুদশ পাবলিকেশনের থেকে বের হয়েছিলো ২০০৭ সালে, যার সম্পাদনা করেছিলেন আমার জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতা পলাশকান্তি বিশ্বাস । আজ কিছু সেই পাঠের অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু বলি ।
জ্ঞানেন্দ্র-গীতিঃ সংকলন ও সম্পাদনা-পলাশকান্তি বিশ্বাস ।
তখন, কত ছোট মনে নেই, বাবা নিজের টুমটুমি বাজিয়ে গান করছেন “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি” । টুমটুমি মানে একতারা,  আর বাবা নিজেই বাজান বায়া । পায়ে কখনো ঘুঙুর বাঁধেন, কখনো নয় । দরিদ্র সংসার, সমস্ত দিনের শেষে এক প্রস্থ আঙিনা, চাঁদের আলোয় গান করছেন বাবা জ্ঞানেন্দ্রনাথ বিশ্বাস । গানের কথা, কখনো লালন ফকির, কখনো দুদ্দু শাহ, কখনো বা নিজের লেখা। বাবা গান করতেন ভাবগান, লিখতেন দেহতত্ত্বের গান। এইসমস্ত গান, গ্রামের দিকে জনপ্রিয় হলেও সমগ্রসাহিত্য মঞ্চে দেহতত্ত্বের গান নিয়ে বাংলা সাহিত্যে উৎসাহী পাঠকের স্বল্পতা নজরে আসে । পাঠকের আগ্রহ কম । লোকসংগীত বা পল্লিগীতি যেহেতু পল্লির গান, আর ব্যবসা বাণিজ্য যেহেতু নাগরিক সভ্যতার মাপকাঠি, সেখানে শহুরে ভাষা, পাশ্চাত্য সাহিত্য, মার্জিত ভদ্র ও সাংস্কৃতিক র‍্যাপার চড়ে বাংলা সাহিত্য বাজার একচেটিয়া অধিকার হয়ে আছে। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ইউরোপে প্রথম ‘ফোক’ বলে প্রচারিত হয় গ্রামের নিরক্ষর, পশ্চাৎপদ কৃষকদের কুসংস্কার পূর্ণ প্রগতি বিরোধী প্রাক-শিল্পবিজ্ঞান-প্রগতি যুগের সংস্কৃতি হিসাবে । কিন্তু এই পোড়া বঙ্গপ্রদেশে তবুও দেখি সেই ভাঙা চালের খরিদ্দার আজও শেষ হয়ে যায়নি,
বরং দেখি কাতারে কাতারে মানুষ গ্রামে গঞ্জে হাটতলায় এখনো বিজয় সরকার, অসীম সরকার, অশ্বিনী গোঁসাইের গানে মাতোয়ারা । এই পল্লিগীতি, ভাবগান, হরিসংগীত যারা করে আর এই গান যারা শ্রবণে আত্মহারা হয়, তারাই বীজ বোনে, পাকা ধান কাটে, নৌকা চালায় । কষ্টে তাদের দিন কাটে । আমার পিতা ছিলেন তাদেরই একজন, তাদেরই গায়ক, সাধক, গীতিকার, সুরকার । বাবাকে পাঁচ গ্রামের সবাই গোঁসাই বলতেন । বাবা,  প্রধানত লালন গীতি গাইতেন । প্রশ্নোত্তরের খাতা ছিল বাবার ।কঠিন প্রশ্নের কঠিন জবাব । সব গানে । হরিসঙ্গীতের অনুষ্ঠান, মহৌতসবে, সাধুগোষ্ঠে যেতেন । বাবা শেষ বয়সে একতারা ও বায়ায় রবীন্দ্রসঙ্গীতও গেয়েছেন । এই সমূহ বাদ্যযন্ত্র দিয়ে যে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া বিধিসম্মত নয়, বাবুদের গোসা হয় । তা বাবা জানতেন না ।  আমি আজ বুঝি । আর বুঝি আমার জানার বোধের পরিধি কত সীমিত । আর এই বাংলা বাজারে আমিই বা কে ? এই হাতে, কলমে, বই, ধমনী বয়ে চলেছে যে গ্রাম্য-জীবনপ্রবাহ,  জ্ঞানেন্দ্রগীতি থেকে একটা গান নিয়ে সেই কথা বলিঃ
“অন্ধকারে বন্ধঘরে ডেকে কারো পাইনা সাড়া ।
আমি দিশেহারা জন্মঅন্ধ দিচ্ছি কতো কড়া নাড়া ।।
নয় দরজায় একজন দ্বারী
ঘরখানা ভূতের কাছারী
চিনি না মন তুমি কোনজন আমিই কেবা বাইরে খাড়া ।।

সংসার পথ পিছল অতি
তায় চলিবার নাই শকতি
ঝঞ্ঝা জঞ্ঝাটে দিবানিশি কাটে , পাইনা কভু পথের দাড়া ।।

গুরুকৃপা হয় না যাহার
কৃষ্ণকৃপায় কি করে তার
অজিতচাঁদের চরণ ভুলেরে মন জ্ঞানা হল হতচ্ছাড়া ।। ”
[গান নংঃ ২ – পাতা ২৩]

গান, গুরু-শিষ্য পরম্পরার । নিজেকে চেনার, নিজের অবস্থান বিচার-বিবেচনার । চেনার নানান রকমফের আছে । জানারও আছে নানান সিনট্যাক্স । খোঁজ থাকে চিরায়ত । শিক্ষাগুরু, দীক্ষাগুরু । গুরুর কৃপায় শিষ্য দর্শন করেন নিজের অবস্থান । সাহিত্য সৃষ্টির আদিযুগ থেকে চলছে আইডেন্টিটি প্রতিস্থাপনের প্রস্তাবনা । অর্থ যশ খ্যাতি খাদ্য বস্ত্র নিয়ে নানান প্রকারের লড়াই, সংগ্রামের ইতিহাস । লালন সাই বলেছেন- “আপন ঘরের খবর লে না / অনায়াসে দেখতে পাবি / কোন খানে সাঁইর বারামখানা ” বা  “আমি একদিন ও না দেখিলাম তারে/ বাড়ীর কাছে আরশি নগর/ এক পড়শি বসত করে”  । নিজেকে নিয়ে উন্মোচনের শেষ নেই, নিজেকে নিজের সামনে দাঁড়িয়ে যে কোন কবি খুঁজে পেতে চায় অস্তিত্ব আর নিজের জিজ্ঞাসায় সে এক বিপন্ন বিস্ময় । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখলেন , “আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ, এই কি মানুষজন্ম ? ” । পল্লি বাংলার চেনার পদ্ধতি আর আধুনিক পাশ্চাত্যের আধুনিকতার খোঁজ কি আলাদা, নাকি শব্দ আলাদা, নাকি বোধ? কবিতা কি জল মাটি আবহাওয়ায় আলাদা হয়ে যায় ? আর একটা গান নিয়ে বলি ?

“আগে জানো মন সেই প্রেমের পরিচয়
প্রেমের সন্ধি জেনে শুদ্ধ রসিক জনে 
            অমৃত ভজনে নির্বিকার হৃদয়।।
মদন মাদন শোষণ মোহন উন্মাদে
প্রেমের জন্ম যে প্রেম কৃষ্ণকে আহ্লাদে ।
মদন বাম নয়নে , মাদন দক্ষিণ কোণে এ দুইয়ের মিশ্রণে শুভ মিলন হয় ।।”
[ গান নংঃ ১২ – পাতা ২৯]

শুদ্ধ প্রেমের এহেন বিশ্লেষণ ও তাকে সংজ্ঞায় বেঁধে ফেলতে চাওয়া, এ এক জটিল দেহতত্ত্বের অবতারণা । একজন বৈষ্ণব , একজন বাউল, একজন সাধকই সেই বাঁধনের গাঁট জানেন । মদন, মাদন, নয়ে নয়ে এই ধ্বনিময়তার এক দারুণ আবেশ আছে ।  তেমন সাংকেতিক সন্ধ্যার এমন ভাষা প্রেমের এহেন গভীরতম প্রদেশে যাওয়ার জন্য এমন ভাবপ্রবাহ তৈরি করে , তা বোধহয় সঠিকভাবে ধরতে গেলে আপনাকে সশরীরে একদিন উপস্থিত থাকতে এমনই কোন বাউল আখড়ায় । আমিও বাবার সাথে বেশ কিছু আসরে থেকেছি । গান শুনেছি, খানিক বুঝিনি, খানিক ভুলে গেছি । মনে পড়ে,  বাবা নিজে গান গাইতেন, লিড করতেন, দোহার দেওয়ার জন্য আরও গায়কেরা মজুত থাকতেন । গ্রাম্য পরিবেশ, দিনক্ষণ মিডিয়া মাইক ছাড়াই আসর বসতো কারো বাড়ির বারান্দায়, মন্দিরে, হাটতলায়। জমে উঠত গানের লড়াই । গান করে কঠিন প্রশ্নের মুখে গুরুকে দাঁড় করিয়ে দিতেন । জটিল সেই বিষয়, দেহের গঠন, মানুষ জীবন, মানুষ যাপন, গূঢ় তত্ত্বের মধ্যে লুকিয়ে থাকতো জন্মমৃত্যুর সওয়াল, আটকুঠুরি আর আঠারো মকামের রহস্যরাজি । জ্ঞানেন্দ্রগীতি থেকে আর একটা গান দেখি ।
“আগে গুরু জান, পাবি তার সন্ধান, মনের মানুষ বর্তমান, খেলছে দ্বিদলে
তার জন্ম মৃত্যু নাই শক্তিতে উদয়, দৃশ্য হবে তাই চক্র ভেদ হলে ।।
চতুর্দল পদ্ম চারিটি অক্ষরে
গুহামূলে দেখ চক্র মূলাধারে
ছয় অক্ষের নির্মাণ চক্র স্বাধিষ্ঠান ষড়দল পদ্ম আছে লিঙ্গমূলে ।

দশ অক্ষরে আছে নাভিমূলে স্থিতি
মণিপুর চক্র তথায় বসতি
দ্বাদশ অক্ষরে গঠিত চক্র অনাহত, সে পদ্ম বিরাজিত হৃদি-দলে ।

আছয়ে বিশুদ্ধ চক্র কন্ঠমূলে
ষোড়শ দলের গঠন ষোল অক্ষর মিলে
ভ্রূদ্বয়ের মাঝে সে যে দু অক্ষরে শুক্ল বর্ণ পদ্ম-দলে ।

দেহ ষটচক্র হলে নিরূপণ
কালের চক্র ফিরে যাবে অকারণ
বলে জ্ঞানদাস বিষ্ণু চক্রে এসে লয়ে যাবে তারে গোলক মণ্ডলে ।” 
[গান নংঃ১৩ --পাতা ২৯]

মনের মানুষ খোঁজা একটা প্যারাডক্স । তাকে দেখা-পাওয়া একটা জার্নি । কিরকম সেই যাত্রা ? কতদিন লাগে ? এতো জিজ্ঞাসা থাকলে, গুরুর কাছে যেতে হবে । গুরুর কথা জানতে আপনাকে যেতে হবে সাধুগোষ্ঠে । শুনতে হবে গুরু আর শিষ্যের গানের আজব লড়াই । কোথায় তার ভেদাভেদ,  কে গুরু কে শিষ্য যা ব্যাকরণ দিয়ে বেঁধে ফেলা যায় না । চলুন বাংলার যে কোন গ্রামে । সবুজ ধানের ক্ষেতের পাশে যেখানে মাটির উঠানে বসেছে তত্ত্বকথার আসর,  রসিকজনের মাঝে গান শোনাচ্ছেন কোন গোঁসাই । জ্যোৎস্নায় ভরে যাচ্ছে ধানের মাঠ । ক্ষেতে সারাদিন শ্রম দেবার পর ক্লান্ত হয়ে আসা চাষা, দিনমজুর কি গান শুনতে চায় ? চিত্রসঙ্গীত, গণসঙ্গীত নাকি ব্যান্ডের গান ? নাকি হিপহপ না র‍্যাপ নাকি ললিত রাগের এগারোতাল ? এই এতকাল ধরেও গ্রামে বরং চলেছে সেই পল্লিগীতির প্রবাহ, এখনো সেই বৃন্দাবনে বাঁশী বাজেরে, কালার বাঁশীর সুরে সুরে ময়ূর নাচে রে । জ্ঞানেন্দ্রগীতি থেকে আর একটি গান নিচ্ছি ।   
“ইটে বাঁধা ভিটেমাটি কি সুন্দর কি পরিপাটি, দেহটি সুরম্য রংমহল।
সে যে কোন কারিগর গড়েছে ঘর দুই খুঁটির পর কলকৌশল
সপ্ততালা রংমহলা দুই বাতি করছে ঝলমল

আট কুঠরি আঠারো মোকাম, মহাজনের সোনার পুরী অটবী তার নাম
রিপু ইন্দ্রিয়গণ করে সংগ্রাম হীন হইলে বুদ্ধিবল
কামিনী কাঞ্চনে ভুলে সমূলে নির্মূল হয় সকল ”
[গান নংঃ ২৮ --পাতা-৩৭ ]

দেহতত্ত্বের গান মানে, মানে দেহের অঙ্গ, তার জন্ম, গঠন, পরিণতি । একা ঈশ্বর সমস্ত জন্মমৃতুর অধিকারী নয়, বরং পিতা মাতার মিলন, আর মিলনের বিভিন্ন সময় ও ধাপের পরে নির্ভর করে মানবজীবন । আটটি ছিদ্র মানব শরীরে । পিতার চার মোকাম, মাতার চার মোকাম, মহাজনের দেওয়া দশ মোকাম । আঠারো মোকাম নিয়ে মানবশরীর । ভাগ্য বা কপাল বলে কিছু স্বীকার করে না দেহতত্ত্ব । মনে হয়  খানিকটা সংস্কৃতির বাইরের । খানিকটা তথাগত বিশ্বাসের বাইরে । তাই অনেকেই অপসংস্কৃতির ধুয়া টানেন । কোন ফরমুলা,  সভ্য সংজ্ঞায় বাঁধা যায় বা । সাহিত্য প্রদর্শিত পথেও চলতে চায় না, ছন্দে, ভাষায়, অন্ত্যমিলে, আচার বিচার বিশ্বাসে এই সমস্ত গানে অসঙ্গতি থাকে । মানব দেহ, আর তার বিকাশ নিয়ে এক অদ্ভুত বিষয়, জন্ম মৃত্যুকে অন্য মাত্রায় লিখে ফেলেন পদকর্তারা । নিজেরাই গান, গানের তাল, রাগ, লয় ঠিক মিলিয়ে নেন । এই মতবাদগুলি যেহেতু কোন সাহিত্য আন্দোলন ম্যানুফেস্ট নয়, কোন শাস্ত্রতে আবদ্ধ নেই, কোন ধর্ম মানে না, কোন গীতা কোরান নেই । আট কুঠরি নয় দরজায় ঘুরে ফিরে আসছে এই গানের সুর । সেই সুরের তাল ধরা তাই এত সহজ ? কোন বস্তুবাদী চাওয়া পাওয়া, বিক্রিবাটা, প্রকাশন, টি আর পি, ফেসবুক,
হোয়াটস অ্যাপ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না । কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বলে তা বহুদূর, মানুষেরই মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতেই সুরাসুর । গানের আসরে উপস্থিত হলে ধনী গরীব হিন্দু মুসলিম বলে কিছু থাকে না । আমি নিজের চোখে দেখেছি, বাবা গুরু সেজেছেন, এক মুসলিম ভাবগান শিল্পী প্রশ্নকারী হিসাবে কৃষ্ণের ভূমিকায় গান করেছেন । আর তার জ্ঞানের সীমা দেখে চমৎকৃত হয়েছেন তাবড় তাবড় গোঁসাইগণ । এইসব আসরে যারা শিল্পী, শ্রোতা, আয়োজক উপস্থিত থাকেন, তাদের বেশীর ভাগ মানুষের মিডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ নেই, তাদের ইউরোপীয় সাহিত্য নিয়ে আন্দাজ নেই, রবিঠাকুরের আলোর তীব্রতা সম্পর্কে ধারণা নেই, তার বুঁদ হয়ে শ্রবণ করে মেঠো সুর আর আপন ইশারায় খুঁজতে থাকে অধরা সেই মনের মানুষ । জ্ঞানেন্দ্রগীতি থেকে আর একটা গান নিচ্ছি ।
“ও মন বুঝলি না রে, ও মন খুঁজলি নারে
ঘর বেঁধে সে ঘরের মালিক রয়েছে ঘরে
গুরুকৃপা বিনে পাবি কেনে অরণ্যেতে ঘুরে ।।

আট কুঠরি নয় দরজা আঠারো মোকাম
চুরাশি অঙ্গুলি সে ঘর এইতো দেহধাম
ছন্দে-বন্দে কত জোড়া
দুই খুঁটির পর আছে খাড়া
সুষুম্না পিঙ্গলা ইড়া বাঁধা তিন তারে ।

পঞ্চভূত আর পঁচিশ তত্ত্বে এ ঘরের গঠন
রুয়োর জোড়া হাড় পাঁজড়া আঠন আর ছাটন
উপর তলায় বাতি জ্বলে
নীচের তলায় গঙ্গা খেলে
মন-মনুরায় মধ্যস্থলে বসত করে রে ।

জ্ঞানদাস কয়, হংসরূপে ঘরখানি খাড়া
পাখি যেদিন উড়ে যাবে ভাঙবে রে আড়া
সাধুসঙ্গ লাগিয়ে প্যালা
বসে থাকো সকল বেলা
জপো হরির নামের মালা শমন যাক ফিরে । ”
[গান নংঃ ৪৯ –পাতা ৪৯ ]

বাউল ঘরানার গানগুলোতে আঠার মোকাম কথাটা বারবার আসে । দেহ এক মন্দির । আর এইখানেই সমস্ত গয়া, কাশী, বৃন্দাবন, মথুরা, মক্কা মদিনা এক হয়ে যায় । প্রতিটা অন্তরায় পদকর্তার নাম রাখা প্রাচীন বাংলার সাহিত্য প্যাটার্নের মধ্যে পড়ে । বাবা যেহেতু লালন ফকির কে মনে মনে দ্রোণাচার্য ভাবতেন, তাই লালনের গানগুলির থেকে সংগ্রহ করেছেন অনেক শব্দ, ভাবনা, তত্ত্ব আর নিজের অভিজ্ঞতা মিশিয়ে করে লিখেছেন জ্ঞানেন্দ্রগীতি । বাবা দেহতত্ত্বের গান ছাড়াও ভক্তিগীতি, প্যারোডি, হরিসঙ্গীত, প্রশ্নোত্তরের জন্য পুরাণ, ভাগবত, মহাভারত, উপনিষদ , হাদিস ঘেঁটে গান লিখতেন । যে কোন গানের আসরে, যে কোন বাদ্য বাজিয়ে উক্ত আসরে নিজের উপস্থিতিকে অপরিহার্য করে তুলতেন । বাজাতেন বাঁশী, বেহালা, দোতারা, একতারা, বায়া, তবলা, করতাল, ঘুঙুর, প্রেমজোড়ি ইত্যাদি । বয়স, লিঙ্গ, ধর্মকে পিছনের সারিতে রেখে উৎসাহ দিতেন প্রকৃত শিল্পীদের । ভালো বেহালা বাজাতেন আমার ছোট কাকা নিত্যানন্দ গোস্বামী । কাকা নিজেই ছিলেন মস্ত বড় ভেকধারী বৈষ্ণব ঘরানার গোঁসাই । তার অনেক শিষ্য এখনও বর্তমান । কাকার আশ্রম ছিল পায়রাডাঙ্গায় । বাবার সঙ্গে ঐ আশ্রমে আমি বেশ কয়েকবার গেছি ।
কাকা বাবার থেকে বয়সে ছোট হলেও, তাকে গুরুজ্ঞানে এমন শ্রদ্ধা করতেন,  মনে হতো যেন কাকাই জ্যৈষ্ঠ । কাকার শিষ্যদের মধ্যে বাবা লেখা গান আজও সমান সম্মানের সাথে গাওয়া হয়। রস আস্বাদনে বাবা অনেক সম্প্রদায়ের মধ্যেই পরিচিত ছিলেন, গান বাঁধতেন উপযুক্ত । গানে সাংকেতিক ও সন্ধ্যাভাষার ব্যবহার ছিল করতেন স্বচ্ছন্দে । একটা গান নিয়ে আলোচনা করি ।
“বাঁকা নদীর পিছল ঘাটে ডুব দিবি তুই কেমন করে
পূর্বতনে পূর্বতনে
কালো কুম্ভীরিনী ঘোলাজলে রয়েছে বদন ব্যদনে
পূর্বতনে পূর্বতনে।।
তিন নদীর এক মোহনা, ডুবেছে রসিক জনা
অরসিক স্থান পাবে না সেই যে ক্রীড়াঙ্গনে ।
যত লোভী কামী, কর্মী জ্ঞানী হারা হল পিতৃ-ধনে
– পূর্বতনে পূর্বতনে ।
ত্রিবেণীর তিনটি ধারে, যেজন স্নান করতে পারে
মহাভাব সফল কর্ম সফল শ্যামপট্ট শাড়ি ধারণে
- পূর্বতনে পূর্বতনে ।
সাধকের সাধনতত্ত্ব, কৃষ্ণের বিলাস মাহাত্ম্য
যেজন জেনেছে সত্য রামানন্দ স্থানে ।
অধম জ্ঞানদাস কয়, সেই চৈতন্য মান্য এ ভবের ভুবনে
- পূর্বতনে পূর্বতনে”
[গান নংঃ ১২৭—পাতা-৯৩]

সাহিত্যবোধ, তত্ত্বকথা, দেহরহস্য, নাস্তিকতা, গ্রাম্য সংস্কৃতি নানান প্রবাহের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি আমরা । শিল্পের নানান ধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি আবার এসে মিশে যাচ্ছি বঙ্গপ্রদেশের জনধারায় । কেউ বলছেন আবহমান, কেউ পুনরাধুনিক, কেউ বা মেটামর্ডান , কেউ বা শুধুই গিমিক । ফর্ম আসছে, ভেঙে যাচ্ছে, আমরা বলছি এটাই সাহিত্যের উচ্চতা, এটাই শিল্পের দৈর্ঘ্য, এইটাই কবিতার প্রস্থ । নানান সাহিত্য আন্দোলনগুলি দেখলে বোঝা যাচ্ছে, এই দেহতত্ত্বের আবেদন, ভাবসংগীত, বাউল নিয়ে কোন উচ্চধারণা মানুষের মধ্যে নেই । তথাকথিত ইলাইট ক্লাস পাশ্চাত্য সাহিত্য নিয়ে বরং অনেক কালচার করছেন, প্রচলিত ধারণার বাইরে যে নিজস্ব বঙ্গ শিল্প সাহিত্যকে আমল দেন নি । বরং ‘ফোক’ বা ‘লোকসংগীত’ বলে আমাদের এই দেশীয় সাহিত্য প্রচেষ্টাকে ভাগাড়ে ফেলে দেওয়ার প্রয়াস দেখি । যারা ‘ফোক’ মানে গ্লামার গ্লামার বোধ করেন, এক কথায় তাদের জানিয়ে দিই, এটাকে আলোকিত কবি সাহিত্যিকরা নিকৃষ্ট মানের সাহিত্য বোঝাতেই ব্যবহার করে থাকেন । অর্থাৎ লোকসাহিত্য হল চাষাভুষা, অশিক্ষিত এক গ্রাম্য সাহিত্য বিশেষ , যা একটা অপসংস্কৃতি । অথচ লালন চলে গেছেন আজ দুই শতাব্দী, দুদ্দু শাহ চলে গেছেন এক শতাব্দী, গ্রামে গ্রামে তাদের উত্তরাধিকারীরা, তাদের জিন গায়ে, ব্যাধি গায়ে , সেই একই রোগ বংশপরম্পরায় আমরা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে । অথচ আমি নিজেই গান শিখিনি, গাইতেও জানি না । বাবা বলতেন, “গান আমাকে কিছু দিলো না, তোরা কেউ গান শিখিস না, পড়াশোনা করে ভাল একটা চাকরি কর, বাড়ি কর, গাড়ি কর” । একজন প্রকৃত শিল্পীর কাছে এ হল এক অভিমান, এমন বঞ্চনার কাহিনীথেকেই শিল্পীজীবন বোধহয় সৃষ্টির রসদ খুঁজে পান ? মানুষ থেকে শিল্পী আলাদা হয়ে যান ।  যেকোনো শিল্পীকেই চেনা অসম্ভব হয়ে পড়ে,  তা পুত্রের কাছে নিজের পিতাই কেন না হন । তাঁর একটা ভিন্ন স্বাদের গান পড়ি ।

“বাংলাদেশের জংলা ব্যাধি হয় না আরাম
ব্যাধি দিনে ভালো রাত্রে বাড়ে যোগেতে ফেরে বারাম ।।

ব্যাধি আগে ছিলো ঠাকুর দাদার
তার পরে হইলো বাবার
এখন দেখি ঘটলো আমার – এ তো বংশগত ব্যারাম ।।

মনে করি সারবে এ রোগ
ঘরে বাইরে হয়ে এক যোগ
যোগ হইলে ঘটে দুর্ভোগ , এর চেয়ে কি আছে হারাম ।।

রোগ হয়েছে বারোমেসে
কই বা কারে সারে কিসে !
বলে অধম জ্ঞানদাসে, খেদে নয়ন ঝরে অবিরাম ।।”
       
[গান নংঃ১২৫—পাতা-৯২]

এই লেখাগুলি মধ্যে অনেক ছন্দের ঘাটতি, পঙক্তিগুলি অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্তের ধার ধারে না । পুরাতন শব্দের চয়ন, গুরুচণ্ডালীর দোষ, অন্ত্যমিলের নানান সমস্যা বিদ্যমান । বর্তমান যুগের সঙ্গে বেমানান আর সাহিত্য মূল্য হিসাবে যা নিম্নপর্যায়ে পড়ে । এটাই মোড়ক, এটা বিক্রি হয়, এটাই অনুপস্থিত । আর নিঃসন্দেহে বলা যায় যে কোন গ্রাম্য গোঁসাই, ফকির, বাউলের পদে এই সমস্যাগুলি বর্তমান । আধুনিক আর অত্যাধুনিক বাংলা সাহিত্য নিয়ে যে সমস্ত গদ্য পদ্য আর কবিতাবোধ নিয়ে কথা হয় তার মধ্যে ভাবগান, বাউল , শব্দগান, সাধু গান, ধুয়া, মুর্শিদি, মারফতি, পাল্লা/প্রশ্নোত্তরি, ফকিরি, কীর্তন পড়ে না । আমরা আধুনিক মানে হতে চেয়েছি পশ্চিমমুখী,  প্রাচীর ওপারে আমাদের প্রবল উৎসাহ, কিন্তু বাংলার নিজস্ব সাহিত্যকে কোন মঙ্গল কামনা ছাড়া আর কি বা করতে পেরেছি, না লিখেছি নিজের কাহিনী , না লিখেছি নিজস্ব কাব্য । দাড়ি, কমা সেমিকোলন সহ, আজও আমরা মোবাইল, কম্পিউটারের গভীরে পাশ্চাত্য ধারা নিয়ে এত বেশী ঢুকে পড়েছি, তার আসল রূপ সরাসরি সাহিত্যের নাগরিক জীবন আর বিক্রিয় ক্ষমতার উপর দাঁড়িয়ে আছে । অর্থাৎ পিজ্জা বার্গার বিক্রয়মূল্য চাল আটার কয়েকশতগুণ অধিক , কিন্তু হিসাব করলে দেখলে দেখা যাবে চাল আটার জন্য ধান গম যবের উৎপাদনকারীরা সেই গ্রাম্য কৃষক, জনমজুর, গাড়োয়াল । জ্ঞানেন্দ্রগীতি থেকে আর একটা গান নিচ্ছি । 
“ঘর গুঁতিয়ে ভাঙ্গলি কেন যে ঘরে তোর উপাসনা
বানাতে যে নেই খমতা ভাঙ্গতে কেন হয় বাসনা ।।
ভালো একটা মুগুর পেয়েছ, মাথায় ফ্যাটা বেঁধেছ
হেঁইও হেঁইও করে তুমি সজোরে ঘাই দিতেছো
তোমার চিরদিন যাবে না সমান, চুপটি করে বোসো না ।।

গুরু যে নাম দিল তোর কানে, একবার ভেবে দেখলি নে
নামের স্বরূপ রাধাকৃষ্ণ তাই শাস্ত্র বাখানে
আশ্রয় গুরু সখী জ্ঞানে কেন তারে ভালোবাসো না ।

দুই খুঁটির পর ঘর খাড়া আছে অনন্ত জোড়া
ছাউনি তাহার উলুখড়ে চামড়াই বেড়া
কত মণিমুক্তা আছে ভরা ( জ্ঞানা কয় ) চিনলি না মন রসনা ”
[গান নংঃ ১৭৯ –পাতা ১২৪]
 
এখন বিচার বিশ্লেষণ করে যা দেখতে পাচ্ছি,  এইসমস্ত জীবন, যাপন নিয়ে খুব মর্মাহত পদকর্তা । যে রেসিপি বা ইনগ্রিডিয়েন্টসগুলি দিয়ে উত্তম পাকের ব্যবস্থা করা হয়, আর যে মশলাগুলির ব্যবহার নিয়ে স্টার সিস্টেমের জন্ম । তবু কোন খাদ্য দিয়েই সেই রসনা তৃপ্ত হয় না । ‘বোধ’ কবিতায় জীবনানন্দ বলেছেন “শরীরের স্বাদ কে বুঝিতে চায় আর? প্রাণের আহ্লাদ সকল লোকের মতো কে পাবে আবার! সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর স্বাদ কই!” । এইতো হল কবিতা । সাহিত্যে শিক্ষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে ভ্যালু সিস্টেমের র‍্যাপার গায়ে চড়ে যায় আর সেখানে প্রান্তিক বাংলা সাহিত্যকে লালন করা যায় নাই ।  পয়ারশ্রেনী কবিতাকে আপনি অমৃতাক্ষর নিয়ে পুনর্বাসন তো দিলেন, শব্দ, সিনট্যাক্স, ধ্বনি, মেটাফর দিয়ে সমহিত তো করলেন, শিল্পী মানুষের ভাবনায় তাতে রকেটগতি এনে দিলো ? আধুনিকতার মোড়কে এখনো পশ্চিমী দুনিয়া আমাদের মোহিত করে রেখেছে । অথচ বাংলা বলতে এখনো একটা বৃহৎ গ্রাম, আর নদীকূলকুল গ্রামের ভিতরদিয়ে যখন বৈশাখের বাতাস খেলে যায়,  আমনের উস্কানিতে মেতে ওঠে মুর্শিদি, ভাটিয়ালি, সেই সুরতান তা আধুনিকতা দিয়ে বোধহয় ধরা যায় না । এর আলাদা উপলব্ধি, এহেন গ্রাম বাংলার কোন এক্স ফ্যাক্টর নেই, যা রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী আর জীবনানন্দের বনলতা দিয়ে পরিমাপ করা যায় । আমাদের চিন্তা মনন আর মৌলিক ভাবনার সমস্ত বীজ এখনো প্যাটেন্ট করা হয়নি, সে সুগন্ধি ভাটিফুল হোক আর ভুঁইচাপার সংক্রামক সবুজ । সুতরাং লালন ফকিরের মতো ‘আনপড়ের’ মতো বাংলা কবি পাঠের বাইরে থেকে গেলেন । কোন স্কুলের এনুয়াল ফাংশনে কেউ তার কবিতা পাঠ করলেন না,  কোন ছাব্বিশে বৈশাখে কোন ফিকির চাঁদ, দাশরথি রায়, দুদ্দু শাহ, হাসন রাজা, অশ্বিনী গোঁসাই, বিজয় সরকারের জন্ম জয়ন্তী পালন হল না । রবির দেশের এইতো মৎস্যন্যায়; রবির কিরণ এতই প্রকট যে, সাহিত্য ইকোসিস্টেমের প্রান্তিক গ্রাম্য চাষি, ফকির, বৈষ্ণব, যোগী, সাধু, গোঁসাইদের বিক্রয়যোগ্যতা যে এক্কেবারেই শূন্য, তা বলাই বাহুল্য । কত কথাই মনে পড়ে, কত অভিমান, কত বঞ্চনার কথা, শিল্পীর একা হয়ে যাবার কথা । বাবার আর একটা অন্য স্বাদের গান নিয়ে আর একটু বলার ইচ্ছে জাগে ।

“যাস নে কেউ ঢাকার শহরে, যাসনে কেউ ঢাকার শহরে
দেখে ঢাকার শোভা মনোলোভা, মুনির মনও হরণ করে ।।
শহরে আছে মজার কল
বেরুচ্ছে সাত রকমের জল
লবণ ইক্ষু সুরা সর্পী (দধি) দুগ্ধ জলন্তল ।
সে জল চেখে দেখে মহাসুখে সাধু জনা পান করে ।।
ঢাকাতে কুণ্ড আছে নয়
আটটিতে নেই কোন সংশয়
একটিতে তার অতল গভীর ব্রহ্মকুণ্ড কয় ।
যত মানুষ গরু করে হরণ রাখে ব্রহ্মা তার ভিতরে ।

ঢাকেশ্বরী আছে ঢাকাতে
চার আঙ্গুল খালি জায়গাতে
লোল রসনা এলোকেশী রয় খাড়া হাতে
তার জিহ্বাখানা লকলক করে রক্ত খাবার তরে ।।

সেখানে যেতে যদি চাও
আগে মাথাটি মোড়াও
কামনা বাসনা ছেড়ে খোদ বৈরাগী হও
অধম জ্ঞানদাস কয় মা মা বলে গমন করো ধীরে ধীরে । ”
[গান নংঃ১৭৮ -পাতা-১২৩]

গান কবিতায় সঠিক উপমা লাগানো একটা চ্যালেঞ্জ । তারপর একটা কাহিনী, বিষয় প্রাসঙ্গিকতা, গতি, ও পরিপূর্ণতা । এইসমস্ত নিয়ে আসরে, বাড়িতে তুমুল আলোচনা দেখেছি । বাবা ছিলেন কৃষ্ণভক্ত গৃহী বৈষ্ণব । গানের ধারা, সামাজিকতা, যুক্তি নিয়ে অনেক আলোচনা হতো, কখনো বুঝেছি, কখনো বুঝিনি । সংসারে থেকে এ আবার কেমন যোগী তার ধর্ম, কর্ম, ঠিকানা কিনারা করা কঠিন । বাউল হয়ে যাওয়া, মনের মানুষের খোঁজ কোন যুক্তি তর্কে লজিকে বেঁধে ফেলতে দেখিনি । বাউল সম্প্রদায়, সহজিয়া যাপনের বিস্তর তত্ত্বকথা রয়েছে । প্রচলিত আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক চর্যাচর্যের সঙ্গে লোক ধর্মের বিস্তর ব্যবধান রয়েছে । পুরুষতান্ত্রিক ব্যক্তি মালিকানা এবং অধিকারকে অর্থ বর্ণ জাতি লিঙ্গ সম্প্রদায় ভেদকে মানে না বাউল ফকির মতাদর্শ । সামাজিক সম্পর্ক এবং নীতি নৈতিকতা এই মতাদর্শে আলাদা । বৈদিক /শরিয়তি দৃষ্টিতে এই মতাদর্শ অনাচারী । আবার এদের দৃষ্টিতে বৈদিক বা শরিয়তি অপসংস্কৃতি । নরনারীর সম্পর্ক স্বতন্ত্র । এদের লিখিত শাস্ত্র, উপসানালয়, নির্দিষ্ট আচার নেই । হস্তলিখিত কড়চায় ও মৌখিক প্রবাহে এ দর্শন এবং সাধ্য সাধনা বয়ে চলেছে । গুরু বা মুর্শিদি ধরে এই ভাবাদর্শ ছড়িয়ে পড়ে । এদের কোন শাস্ত্র বা আচার বা উপসানালয় নাই । আছে সাধুসভা । গুরুশিষ্য পরম্পরা । গুরু মানে ভাববাদী তত্ত্ব নয়, অগ্রজ পথপ্রদর্শক । এরা পরলোক, জন্মান্তর, ধর্মাচার-ব্রত-উপবাসাদির বিরোধী, এই তত্ত্ব অনুযায়ী বাউল সম্প্রদায়রা নাস্তিক । জগত সৃষ্টির ব্যাখ্যার জন্য তারা ঈশ্বর কল্পনা অনর্থক মনে করেন । অনেক সাধক শক্তিপ্রবাহের অন্তঃস্থলে আকার সাকার নিরাকারের আড়ালে দেহে চেতনায় নির্ভুল ভাবে উপলব্ধি করেন চৈতন্যকে, জ্যোতির্ময় নবীর নুরকে । দেহের জন্ম উপাদান রজেঃবীজে তার নিশ্চিত অবস্থান চিহ্নিত করে ।

এতক্ষণ পাঠে এতোটা তো ক্লিয়ার যে ভাবগান-শব্দগান-দেহতত্তের গান, বাংলার অপরিহার্য একটা সাহিত্য ধারা ।সঠিক যোগাযোগ আর যথাযথ উপস্থাপন হলে, গ্রামবাংলার গান, বাংলার আপন হয়ে ওঠে । লোকসঙ্গীত লোকের হয়ে ওঠে । বলতে দ্বিধা নেই, এই গ্রন্থের পর্যালোচনা করা, ভক্তিগীতি গায়ক জ্ঞানেন্দ্রনাথ বিশ্বাসকে ঠিক বেঠিক মাপকাঠিতে দাঁড় করানো, তার লাইন বাই লাইন বিশ্লেষণ করা একটু কঠিন । অধিকাংশই আমার জানা ছোঁয়ার বাইরে । আমি যতটুকু উপলব্ধি করেছি, শুনেছি, উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি, তাই নিয়ে আমার পাঠের অভিজ্ঞতা, উঠে আসা অনুষঙ্গ নিয়ে সাধারণ কিছু কথা রাখলাম । লৌকিক সাহিত্য নিয়ে লিখতে বসলে গ্রাস-রুট লেভেলে কাজ করা প্রয়োজন, আখড়ায় ধুলোর মাঝে হাঁটু গেড়ে বসা, হাটখোলায় শিশির পড়া রাতে গান শোনা, প্রান্তিক গ্রামের মাটির ঘরে সাধুগোষ্ঠে যাওয়া অনিবার্য । লোকসাহিত্য লোকের মাঝেই আছে, আর যদি এর ধারক বাহককে আমরা লোক মনে করি । ক্ষমতা, রাজনীতি, ধর্ম, আইন, কানুন, বাজার, মিডিয়া কিছুই তাদের আলাদা করতে পারে নাই । লোক নিজের নিজের মনের মানুষের খোঁজ এখনো জারি রেখেছে, নিজের মতো করেই তারা খোঁজেন, তার কোন ডকুমেন্টেশন নাই, তার কোন পুলিতজার নাই, একাদেমী বা জ্ঞানপিঠ নাই । অথচ আজও গীতিকা বন্ধ হয়ে যায়নি,  হরিবাসরে আজও রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া হয় না, সাধুগোষ্ঠে কেউ নজরুলগীতি গায় না, চুটিয়ে চলছে বিজয় সরকার, অশ্বিনী গোঁসাই, ফটিক গোঁসাই, হরে কৃষ্ণ দাস, মুস্তাকিন শেখ বা  জ্ঞান গোঁসাই । ভক্তিগীতি, দেহতত্ত্বের গান, দেহী মানুষ ও তাদের মঙ্গলামঙ্গল এদের ধর্মাধর্ম, মানুষ এদের উপাস্য, অন্বিষ্ট । এদের জৈব ধর্মবিশিষ্ট দেহে বাস করে ব্রম্মসত্তা, কৃষ্ণ । আজাজিলের নির্মিত দেহে বাস করে আল্লার নুর ।   

এই উচ্চ নীচ, গ্রহণযোগ্যতা, বিক্রয়যোগ্যতা, সুপার মার্কেট, ই-কমার্স জায়ান্ট এমাজোন, ফ্লিপকার্ট, ওয়ালমার্ট নিয়ে যখন ঘাটি গেড়েছে খোদ ভারত বর্ষে, মুনাফালোভী উচ্চ সম্প্রদায়, ব্যাবসায়িক, উচ্চপদস্থ সরকারী বেসরকারি ব্লু-কলার কর্মচারীদের কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ একটা লাইমলাইট জীবন, আলোঝলমলে মহানগর । প্রান্তিক কবিরা থেকে যাচ্ছেন দূরে, কোন দূর সীমানার ওপারে । বাংলার নিজস্ব সাহিত্যের মৌলিকতার প্রতি তাদের কোন দায়বদ্ধতা দেখতে পাই না । শুধু সাহিত্যই নয়, বরং বলা যায় পোশাক, পরিধান, খাদ্য, প্রেম, চুমু, যৌনতা প্রবলভাবে পাশ্চাত্যের অনুকরণে । সেই অনুযায়ী বিক্রয়যোগ্যতা ও সাহিত্যমাধ্যমের দরদাম । বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতিকে আমরা গ্রাম্য বলে দূরে ঠেলে ফেলে দিলাম । পঞ্চায়েত ভোটে অশিক্ষিত চাষাকে পরাজিত করে আনন্দে উল্লাস করে উঠলাম । রাজধর্ম পালন করে বিরাট খেতাব নিয়ে বইমেলা করলাম । কেউ জানতেই পারল না অশ্বিনী গোঁসাইের নাম । কখন যে বিজয় সরকার গেয়ে উঠেছেন “এই পৃথিবী যেমন আছে তেমনই ঠিক রবে , সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে” । আমার বাবাও চলে গেলেন । আনুমানিক ১৯৩৫ সালে বাবার জন্ম, বাংলাদেশের কালীগঞ্জ থানা অন্তর্গত মহাদেবপুর গ্রামে ।
গত ১৪ জুন ২০১৪ তে, নদীয়ার ধানতলার অন্তর্গত হাট-বহিরগাছিতে তার মৃত্যু । এই পৃথিবী থেকে বাবা চলে গেছে, কতবছর হয়ে গেলো ।বহিরগাছি, বিশ্বনাথপুর, প্রতাপগড়, হিমাইতপুর, শেয়ালডাঙ্গা, রুপদহ, বয়ারডাঙ্গি, ট্যাংরা, হাঁসখালি, বগুলা, মুড়াগাছা, কৃষ্ণনগর, কুলগাছি, আসাননগর, ভিমপুর, মালিপোতা, রাণাঘাট, পায়রাডাঙ্গা, বাগদা, হেলেঞ্চার পথে পথে, সাধুগোষ্ঠে, ভাগবত পাঠের আসরে, মহৌতসবে, নামগানে, বাউলের আখড়ায়, হরিকীর্তনে তার জ্ঞানেন্দ্রগীতি জেগে আছে ।

No comments:

Post a Comment