Friday, March 9, 2018

পাঠকামী-২২

পাঠকামী-২২

যা কিছু পড়ার , হাতের কাছে লব্ধ কন্টেন্টের উপর নির্ভর করে থাকি । তা নিজে সংগ্রহ করে বা কারো উপহার । বই , ম্যাগাজিন, ইন্টারনেট নানান সোর্স । ইদানীং যোগ হচ্ছে কুরিয়ার । এটা যে একটা ভালো অপশন, তা এক্সপ্লোর করে দেখি । ডাকে আসা বইগুলির প্রতি একটা আলাদা দায়বদ্ধতা থাকে । পোস্ট অফিস যাওয়া, প্যাকিং করা, স্ট্যাম্প কিনে পোস্ট করা অনেক সময়ের ব্যাপার আর মানসিকতার কেমিস্ট্রি কখন যে পেকে ওঠে মনে জারে, পদার্থ থেকে মৌলগুলিকে ততদিন আলাদা করা যায় না, এই ধরুন “স্বপ্নের জেহাদি ও অন্যান্য গদ্য” বইটি । অনেকবার নিজে ইচ্ছা করেও সংগ্রহ করতে পারিনি । ডাকেই এলো । আজকের পাঠকামিঃ

স্বপ্নের জেহাদি ও অন্যান্য গদ্য প্রদীপ চক্রবর্তী ।

সাধারণত আমি কবিতাই পড়ি, কিন্তু যা দেখছি ক্রমাগত গদ্য পড়ার একটা নেশা বা তাড়না বয়ে বেড়াচ্ছি । যে কোন গদ্যও ঠিক করে উঠতে পারিনি,তবে কবিতা বিষয়ক গদ্য হলে পড়ে ফেলতে পারি একটা বই। তিনটে পর্বে এই বইটাতে মোট পঁচিশটা গদ্য স্থান পেয়েছে । গদ্যগুলি বিভিন্ন সময়ে লেখা, বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় বেরিয়েছে । পাঠক পড়েছে, ভুলে গেছে, হারিয়ে গেছে । পত্রিকাদের কিছু ছিঁড়ে গেছে,কিছু লুপ্ত হয়ে গেছে, সম্পাদকরা অনেকেই সশরীরে আছেন, অনেকেই নেই, অনেকে গা ঢাকা দিয়েছে ।

স্বপনের জেহাদি শুরু হয় সহজ পাঠ দিয়ে, যেভাবে ডেভেলপ হয় কগনিটিভ বোধ, কবিও শেখে, গদ্যকার ও । 'অ' আঁকা থেকে পুরোপুরি বাক্য গঠন, আচমকা শম্ভু রক্ষিত চলে আসেন, দৃশ্যপট ডিসটর্ট হয় । নিজের আমূল ধারনা গেঁথে দেন ভাষ্যের গভীরে । মালকোঁচা আঁটা বাঙ্গালীর ইমেজ হারানোর ভয়ও এক ধরনের আত্মম্ভরিতা । কোন ইম্প্রোভাইজেশন নেই । নেই সম্ভাবনাময় সম্পর্কের মধ্যে সঠিক মুহূর্তকে চিনে নেবার ক্ষমতা । কেবল টি আর পি বাড়ানোর জন্য মুঢ় 'প্যামফ্লিটিয়ারিং' এ নিজেকে রেখে দেওয়ারা দৌড় । সেই মুহূর্তে নিজেকে রাখেন কবি এই সময়ের শক্তিশালী কবি প্রদীপ চক্রবর্তী । 'অনলি হোয়েন উই আর নো লংগার আফ্রেড, উই বিগিন টু লিভ' ।

জীবন্ত বা লাইভ, সরাসরি গা ঝাড়া মেরে উঠে দাঁড়ান কবি, এক গদ্যকারের ভূমিকায় । উঠে আসে কবিতার উৎস, লেখার কাঁচা মাল, শ্রমের আদি তাড়না আর অধ্যবসায়ের নিয়মানুবর্তিতা । বিভিন্ন অনুষঙ্গ আর তার বিস্তৃতি নিয়ে কবিতার নিজস্ব ভূমি তৈরি করতে আসেন কবি । বাংলা বাজারে আজ যারা কবিতা লিখতে এসেছেন, আর যারা কালজয়ী হবার ফন্দিফিকির খুঁজছেন তাদের জন্য রয়েছে গরম হটডগ আর মেক্সিকান চীজ । আধুনিক কবিতার শুরু আর অভিযোজনের প্রতিটা প্রক্রিয়াকে এই গদ্যে ধরে ফেলার অসামান্য কাজ প্রদীপ চক্রবর্তী এত দিন ধরে করে যাচ্ছেন তার ছিটেফোঁটাও আমাদের তরুণ প্রজন্ম জানতে পারছেন না ।

কি করে পারবেন , টি আর পি ছুটে যায় যে ।  যা আজ আছে কাল নেই, তবু কালকের উজ্জ্বল প্রস্তুতির জন্য আজকের ফ্যান ফলোইয়ং কেই বা জলাঞ্জলি দিতে চায় ? এই সব থেকে দূরে , আপন আলয়ে নিভৃতে রচনায় লেগে থাকেন মগ্ন কবি, তুলে  আনেন বিভূতিভূষণের কথা, আনেন উর্মিমালার কথা, সাহিত্য , মননে, মেধার একটা বেঞ্চমার্ক তৈরি করেন কবি প্রদীপ চক্রবর্তী । সিরিজ অফ স্ন্যাপশট । কবিতা নিতে তিনি বক্তব্য রাখেন - " মহৎ কবিতার জন্ম সেই অর্থে আর হয় কিনা , জানি না, মহৎ কবিতায় বিশ্বাসীও নই" । কবিতা তত্বের বাইরে এসে নিজের কবিতা চর্চা করার কথা বলতে চান । কোন এক অখ্যাত অভিযাত্রীর কোন সামান্য অনুভবের তাপে নিজেকে স্নানের কলিং-এ বেজে উঠতে দ্যাখে ।

এখন কবিতা নিয়ে বলতে গেলে, যে শিল্প বোধ আর পাঠকের কথা আসে, সেই পাঠক নিজেই এগিয়ে আসে কবিতার ভিতরে ঢুকতে , কবির চিন্তার পরিসরে ঢুকে পড়েন পাঠক নিজের কবিতা নিয়ে, নিজস্ব পরিপার্শ্ব ও দিন যাপনের অভিজ্ঞতা নিয়ে । কবি প্রদীপ চক্রবর্তী কখনো সেই পাঠক বা কখনো সেই কবি , এক ফ্রেমের ভিতর ঢোকেন, অন্য ফ্রেম ফ্রিজ হয়ে যায় । তার আলোচনা, উদাহরণ, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও আনুষঙ্গিক ঘটনাপ্রবাহ একটা চিত্র গঠন করে, আমি আজ তার গদ্য পাঠ করতে গিয়ে বুঝতে পারছি এই পিপাসা অনন্তের, আবহমান । কবির নিজের গ্রাম দেখা, শহর দেখা, সংসারের টানাপড়েন , কর্মক্ষেত্রের জিজ্ঞাসা পৃথিবীকে নতুন করে চেনায়, তার পছন্দ ও ভালবাসা, তার ব্যক্তিগত ধারনা সমূহ একটা মৌলিক পারসোনাকে চিত্রায়ন করে । তার চ্যালেঞ্জ, দর্শন, সন্ধান, নিজেকে ভাঙ্গা একাকার হয়ে যায় । এই কবিকে পড়তে গেলে তাই তার ভাবনা সমূহকে জানার প্রয়োজন ।  তার উৎস ও বিকাশ , অভিযোজন এই সব আজকের পাঠকদের জন্য অপরিহার্য । অথচ আমরা যেটা প্রতিদিন যা দেখি, বারবার বেশী করে এক্সপ্লানেশন করে দেওয়া, অর্থ সংজ্ঞাবদ্ধ করা , বাণিজ্যে বসতি ও বিজ্ঞাপনের অতিষ্ঠয় একটা কম্ফোর্ট জোনের ভিতর থাকতে চান  । কবি কি তাদেরকে ঘর থেকে টেনে বের করে আনবেন পাঠের ময়দানে ? না । কবি নিজেই একা হয়ে যান । কবি লেখেন ।
"মানুষের ভূগোলের থেকেও সর্বগ্রাসী আধিপত্যবাদের অনুগত পোষ্য জীবে পরিণত না হয়ে নির্জন কুমোঘরে সারাজীবনের ঘোর তাকে অমোঘ সৃষ্টির নেশায় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়" ।

অনেক লেখা, আর অতি যত্নে লেখা বলে লেখাগুলি একটা ঘোরে বেঁধে রাখে । নিজের শৈশব আর লার্নিং প্রসেসগুলি আবার রিভিউ করার একটা সুযোগ আসে । আমরা কি ভাবে পড়তে শিখি,লিখতে শিখি, শিখে নিই মার প্যাঁচ, গাছে চড়া, পড়ে যাওয়া, আবার উঠে যাওয়া, জলে ঝাপ দেওয়া । এই সব আমাদের কগনিটিভ শিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার সূত্রমালা সামনে নিয়ে আসে প্রদীপদা । অনেক জানা কথা, অনেক না জান, অনেক অপ্রকাশিত কথা সমস্তই আজকের এই কবিতার পটভূমি । কবিতা বোধও তো একটা শিক্ষার বাই প্রোডাক্ট । কবি প্রদীপ চক্রবর্তী তাই বারবার শিশুর কথা আনেন তার আলোচনায়, সেখান থেকে ধীরে ধীরে ম্যাচুয়র্ড হতে থাকে চিন্তাসূত্র । পাঠকের কাছে প্রদীপ চক্রবর্তী বোধ্য হয়ে ওঠেন যার কবিতা একসময় পাঠক দুর্বোধ্য বলে সাইড লাইন করে দিয়েছেন । আসলে প্রথম জীবন, সেখান থেকে বেড়ে ওঠা, প্রথম অপটিক্যাল ক্যামেরার চোখে দেখা সাদা কালো ছবি , যা আমরা বড় হয়ে কদাচিৎ সেই ভাবে দেখি, জংলা ফুল, লাল সুরকি রাস্তা, নুড়ি পাথর ঘেরা বাংলো বাড়ি, আঁশটে পোড়া গন্ধ - দৃশ্যের পর দৃশ্যান্তরের বায়স্কোপ । অস্পষ্ট হয়ে আসা স্মৃতি, বালক মন একদিন সমাজ, বন্ধন , রুলস, রেগুলেশন বুঝতে শেখে, কিন্তু মাথার ভিতর থেকে যায় স্বপ্নের বাহন, কিছুটা দাগ রেখে যায় শৈশবের ফুরিয়ে যাবার যাপন সমূহ ।
 
এই ভাবে পড়ে ফেলা যায় তার গদ্যগুলি "স্বপ্নের জেহাদি", "অবেলার টুপুর অলীকে আছে ? " , "চাঁদ ভাঙা পক্ষীরাজ ঘোড়া" । এরপর আসে কিছু পুরানো কবিতার একাডেমিক আলোচনা, তাদের ইতিহাস ও ভূগোল, রবীন্দ্রনাথ, সুধীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, অজিত দত্ত, জীবনানন্দের কথা। আরও অনেক কবিও আসেন, তারা কি দিতে পেরেছে, কি দিয়েছে আর কি দেন নি এবং নতুন কবিতা কী কী দিতে পারে । এইখানে অনেক তত্বকথা আলোচনা করেছেন কবি প্রদীপ চক্রবর্তী, যা নিজেরই বিরুদ্ধে কিছুটা যেখানে তত্বকথা বলবেন না বলে প্রথমেই নস্যাৎ করে দিয়ে শুরু করেছেন । তবে পাঠকের কথা ভেবেই হয়তো "খুশবু--এখানে পিঞ্জর এবং সুচেতনার চোখ" এই গদ্যটির অবতারণা যেখানে তিনি সমসাময়িক কবি ৭০ দশকের বারীন ঘোষাল, শংকর লাহিড়ী, কমল চক্রবর্তী, ৮০ র কবি ধীমান চক্রবর্তী, স্বপন রায়, রঞ্জন মিত্র, অলোক বিশ্বাস, প্রণব পাল, আর্যনীল মুখোপাধ্যায় , রাম কিশোর ভট্টাচার্য, জহরসেন মজুমদার দের কথা উল্লেখ করেন ।


পড়তে পড়তে চলে অনেক চেনা ও না চেনা কবিতার আলোচনা । আমার সীমিত জ্ঞানে ধরার চেষ্টা করি । আমার মনে হয়, কবিতাগুলো আলোচনার সময় তেমনই ব্যক্তিগত কাব্যধারণার বিশেষ এঙ্গেল তুলে ধরেন কবি প্রদীপ চক্রবর্তী । জ্ঞান কখনোই কমপ্লিট নয় । একটা ধারনা মাত্র । কবিতা সেখানে স্ট্যাটিক একটি বিষয় । কবিতার সঙ্গে সঙ্গে গদ্যকারে দৃষ্টিভঙ্গিও প্রকাশ পেতে থাকে । কোন কোন জায়গায় দৃষ্টিভঙ্গি মেলে বা কোন জায়গায় মেলে না । সেটাই স্বাভাবিক । "কিছু স্বপ্নঃ কিছু মুহূর্তঃ কিছু অনুভব", "শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতা", "রাতের ছায়াপথে তিন কবি" । এইগদ্যগুলোতে কবি প্রদীপ চক্রবর্তীর কবিতাযাপনের চিত্র ধরা আছে । তার দৈনন্দিন কাব্য চর্চা, কাব্যধারনা, প্রভাব, অনুশীলন বিভিন্ন কবি ও কবিতার লাইনের ফাকে আবিষ্কৃত হয় । গদ্যের ভাষা, চরিত্র, শব্দচয়ন মুনশিয়ানা রাখে । বোঝা যায় যত্নে লালন করেছেন ।

বইটি পড়তে আমার অনেকদিন লেগে গেলো । আর এই নিয়ে লিখতে আরও বেশী দিন । আমার নিজের সময় কবিতা কম, ক্যাচআপ টাইমেই বেশী লাগে । তারপর যোগসূত্রগুলো জুড়তে খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায় । সেই সঙ্গে একটা পাঠ-দায়বদ্ধতা আমাকে ঘিরে রাখে, চেষ্টা করি, কিছু একটা ব্যক্তিগত মতামত জানানোর । বিশেষ করে যদি কবিতা নিয়ে প্রদীপ চক্রবর্তী ৩০৩ পাতার গদ্য লিখতে পারেন, তবে আমি ৩ পাতার একটা মতামত লিখতে পারবো না ?

বিশেষ রসবোধ চলে আসে "খেয়াল রসের ভোর" গদ্যটা ঘিরে । এইখানে যে প্রদীপ চক্রবর্তীকে আমি চিনি, সেই প্রদীপের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় । কবিতার ভিতর থেকে কবি উঁকি মারে । অনেক অজানা কথার উপস্থাপনা হয় । নিজস্ব গদ্য রচনারও একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে যেতে চান । কিকরে কবি হিসাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন, পাঠ্যবস্তু সংগ্রহ করেছেন । উঠে আসে মণীন্দ্র গুপ্তের কথা, কলেজ স্ট্রীটের কথা, তার বাইরের কথা, রঞ্জিত শিংহের কথা, বারীন ঘোষাল কমল চক্রবর্তীর কথা । আর যেভাবে বাক্য গঠন করেন, মনে হয় অপার যত্নের কথা, মনের গভীর থেকে মন্থন করে উপস্থাপন করে অপূর্ব অক্ষরমালা । একটু উদাহরণ দিই ।
"কবিতা তো অনেক পড়েছি। কখনও আলস্য নেমেছে চোখে, আনন্দের বর্শাফলক মর্মর ভেঙে কখনও মনশ্চক্ষুতে অনুভবের শিখা জ্বালিয়ে তুলেছে শতগুণ । কত ঝোপঝাড় কাঁটার আঁচড় খানা খন্দ বাদা-বাঁওড় ডিঙ্গানো । কত ডাগর চাঁদের বুক জিরানো অনশ্বর আলো "
এগুলো হল কবির ভাষা, কবির গদ্য ।  যে নিজেকে প্রতিক্ষণে কবিতা যাপন করেন ।  তার ভাবনা চিন্তা ভূত ভবিষ্যত কবিতাকে ঘিরে । তাকে আমরা কোন সময় বুঝি , কোন সময় বুঝি না, কোন সময় সে দুর্বোধ্য থেকে যান । কোন সময় নিজেকেই কন্ট্রাডিক্ট করেন । কাগজে লিখে ফেলেন কবিতা,কোন সময় লিখে লাইন কেটে দেন । নতুন কবিতার জন্ম নেয় ।

নতুন কবিতা নিয়েও অনেক কথা আছে এই বইটায় । নতুন কবিতার ধারা, প্রস্তুতি, বিস্তারিত হওয়া, নিজেকে নতুন কবি ট্যাগ করা, এবং তদুপরি ক্রমানুসারে নিজের সাক্ষর আবিষ্কারের মধ্যে রয়েছে তার যাবতীয় লেখ্যবস্তু । নতুন শব্দ, নতুন ভাব ও ব্যবসায়ীদের কি সম্পর্ক সেই নিয়ে তার আক্ষেপ । তার মতে একজন কনভেনশনাল কবি এভারেজ ১৫০-২০০ শব্দের পুঁজি নিয়ে কবিতা লিখতে আসেন, তার লেখায় নষ্ট ফোড়নের ঝাঁঝ কোনদিন আসবে না । এই প্রসঙ্গে তিনি রমেন্দ্রকুমার আচার্যের কথাও আনেন । তার একটি কবিতা নিয়ে আলোচনা - মনোমুগ্ধকর ।

কবি, পাঠককে দেন একটা চিন্তাসূত্র । পাঠক আটকে যান ভাবনাজালে,  নির্জনে বসে ভাববার মতো কোন ধারনা পাঠককে বুঁদ করে রাখে ।  কিন্তু অনেক সময় কবি নিজেই এলিয়েন হয়ে যান । একলা হয়ে যাওয়া তাকে কুরে কুরে খায়, নিঃশেষ হয়ে যেতে থাকেন, কবিও বোধহয় তাই চান । নিজেকে উজাড় করে দেন,  'দুজন পথ ভোলা কবি, একাকীত্বের সাধনা থেকে উপার্জনে' । কবি সজল বন্দ্যোপাধ্যায় কে নিয়ে আলোচনা করেন । ফর্ম নিয়ে কথা হয়, ছেদচিহ্ন নিয়ে কথা হয়, সংকেত, অস্থিরতা, স্বতন্ত্রতা, কনটেন্ট, পরিণাম, আঙ্গিক, চেতনাস্রোত, বিমূর্ততা, আবহ । খোঁজ চলতে থাকে, আপেক্ষিক অস্তিত্বের সমীকরণের কথা সামনে চলে আসে । একটা লাইন তুলে দিই ।  "অবয়বহীন সংবেদিত দুরপনেয় চেতনার সংরক্তিক বিন্যাসে রক্তস্বেদ সংগীতের ঋজুতম দ্বান্দিকতার সহাবস্থানে জারিত দ্বিধাদ্বন্দের উত্থানপতনের ব্যতিক্রমী সংশয়" ।  আর কবির কথা তুলে ধরেন তিনি হলেন রঞ্জিত সিংহ । সুধীন্দ্রীয় ঘরানা, টি এস এলিয়টের, ফ্রয়েড, এডলার ও ইয়ুংএর প্রভাব নিয়ে আলোচনা হয় । সেই সমস্তই আমার অজানা । আমি বুঝলাম কোন রিভিউ হবে অথবা আমারই মতো কোন পাঠকামি । এরপর আলোচিত হন আরেক কবি দেবীপ্রসাদ বন্দোপাধ্যায় । তাদের বেশ কিছু কবিতা নিয়েও আলোচনা হয় ।  আর একজন কবিকেও আলোচনা করেন "একজন প্রডিগ্যাল খালাসির অগ্রন্থিত দহন ও কবিতালিপি" গদ্যে । তিনি হলেন উদয়ন ঘোষ । এই কবিকে আমি কোনদিন পড়ি নাই । কিন্তু এই গদ্যে পড়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম । যেটা প্রদীপ চক্রবর্তী তুলে ধরার চেষ্টা করলেন,  মূলধারার কবিতার কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে কেন্দ্রাতিক চলন, যেখানে বিনির্মাণ, বিগঠন ও বিযুক্তির মধ্যে দিয়ে উৎস কবিতাকে চেনার চেষ্টা করেন । আমার কাছে অজানা হওয়ার কারণে ভাল অনুধাবন করতে পারলাম না ।

নতুন কবিতা আর মূলধারার বাইরে আমি অনেক কথা পড়ি এই গদ্যগুলোতে । আমার কাছে প্রদীপ চক্রবর্তীকে মনে হয়েছে উনি কিছু বলতে চান, কিন্তু এ পর্যন্ত তা ক্লিয়ার হল না । কিংবা হতে পারে আমি পৌঁছাতে পারি নাই । কিংবা আমিও সেই শিশুর মতো প্রশ্ন করতে চাই, এর কি কোন ম্যানিফেস্টো স্থাপন করার আছে ? ব্র্যান্ডিং অপশনগুলি যদি আমি নালিফাই করি, এই গদ্যগুলি সুপাঠ্য, অনেক তথ্যনির্ভর এবং প্রাণ দিয়ে লেখা ।

"অংশত অনুভব , ছেঁড়া ডায়েরীর কয়েকটা পাতা..." আমার বিশেষ করে ভালো লাগলো । এখানেও তিনি কিছু কবির নাম করেন, তাদের সংগে নানান ভাবে ইন্টার‍্যাকশনের কথা আসে । মঞ্জূষ দাশগুপ্তের কথা,  ডায়েরীর তারিখ আসে, সময় আসে, কবিতার রসের কথা আসে, উপভোগের কথা আসে ।  এই সূত্রে কিছু কবিতা পড়াও হয় ।

প্রতিটা গদ্য নিয়ে অনেক কিছু আলোচনা করা যায় । আমার মনে হয় এই গদ্যের বইটি ভালো করে পড়া হয় নাই । তরুণ প্রজন্মের কবিদের জানার দরকার আছে, আজ যারা কবিতা চর্চাকে আলাদা গতি দিয়েছে, তাদের এই পূর্বসূরিদের জানার মত এত ভালো গ্রন্থ আমি দেখি নাই । যেমন গদ্যের ভাষা, তেমন তথ্যের জোগান, তেমন পারসোনিফিকেশন । আমাকে তার যোগ্য পাঠক মনে করে প্রদীপদা দূর দূর্গাপুর থেকে বইটি পাঠিয়েছেন । তাকে আমার ধন্যবাদ ।

বইটির তৃতীয় পর্বে আসে অন্য প্রদীপদা । স্বদেশ সেনের কথা । এযাবৎ সবচেয়ে বেশী আলোচিত কবির নাম । মেনস্ট্রিম বা প্যারালাল - দুধরনের পাঠক সমাজেই দারুণ জনপ্রিয় নাম । আমিও পড়েছি ওঁর কবিতা । "অনুভবের একটা কথা" ,বেশ এনজয় করলাম । ইন্দ্রিয়চেতনা, কবিতা দর্শন, সেই শিশুর কথা ফিরে আসে, কগনিটিভ শিশু, আমিও শিখতে থাকি নতুন পৃথিবী । অনেক কবিতা নিয়ে আলোচনা হয় আর প্রত্যেকটি পাঠে মনে হয় নতুন কবিতা । অনেক জানা কথা, অনেক নাজানা কথা উঠে আসে । লেখকের অনবদ্য লেখনীতে উপভোগ্য হয়ে আসে আলোচনাও । এই পরিণতি পেতে আমাদের আরও কিছু মাইল হেঁটে যেতে হবে ।

"অন্ধকার কারুশিল্পী" গদ্যে কবি সুশীল ভৌমিক নিয়ে লেখেন । তার কবিতা কেন লেখকে নাড়া দিলো তার আলোচনা । "অন্ধকার মামড়ি খসে পড়ে'" গদ্যে আলোচনা করেন কবি ধীমান চক্রবর্তীকে নিয়ে । ব্যক্তি ধীমান চক্রবর্তী, কবি ধীমান চক্রবর্তী, চিন্তাবিদ ধীমান চক্রবর্তী । একমাত্র এই কবির সঙ্গেই আমার মুখোমুখি আলাপ হয়েছে । বলা যায় চেনা ক্ষেত্র । দারুণ ভাবে ধীমান চক্রবর্তীকে ধরেছেন । তথ্যে, ভাষায়, কবিতায় । "স্বপনপারের ডাক শুনেছেন 'জহর'" গদ্যে ধরেছেন জহর সেন মজুমদারকে । এই কবির সম্পর্কে আমি প্রথম শুনি দিল্লির কবি দীপঙ্কর দত্তের মুখে । বিস্তারিত জানা হলো প্রদীপদা গদ্যে । এ ছাড়াও "আশির তিনকবি ও কয়েকটি কবিতার মুহূর্তে" গদ্যে ধরেছেন পার্থপ্রিয় বসু,স্বপন রায়, ও অলোক বিশ্বাসের কথা। বিস্তারিত আলোচনা। উদাহরণসহ । "মুখোশের পোর্টেট" গদ্যে ধরেছেন রতন দাসকে । "উমাপদ করের-পরিযায়ী চলো'" তে কবির কবিতাযাপন, "কাহাদের কথা, হয়তো বা কমলাকান্তের উট" গদ্যে প্রশান্ত গুহ মজুমদার ও রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে লিখেছেন প্রদীপ । "অংশত নব্বই দশকঃ তাপস কুমার লায়েকের একটি কবিতার বই " কিছু কবির নিজেরই কথা  এবং অবশয় তাপসকুমার লায়েক ।   ভাব প্রকাশের পদ্ধতি, বাক্যবন্ধ , শব্দের বহুমাত্রিক ব্যবহারের কথা এমন সময় এমন ভাবে আলোচনা করেছেন যা মাত্র একজন কবির পক্ষেই সম্ভব ।  তার এই গদ্যশৈলী প্রাণবন্ত, তথাকথিত একাডেমিকদের রিভিউ থেকে উপভোগ্য মনে হয়েছে ।

কবি বলেই হয়তো এত কথা জমে থাকে, এত কিছু ভাবা যায় । নানান প্যারামিটারগুলো চোখের সামনে ভাসে । শুধু ধরে ফেলা । কবির চোখে কবিকে দেখা একটা অভিজ্ঞতা তো বটেই, তবে কবি হিসাবে তার নিজের কিছু ধারাবিবরণী থাকে, থাকে নিজস্ব কিছু ভাষ্য । নিজের কবিতা ভাবনা আর চিন্তাসূত্রের বিস্তার । নিজস্ব ধারনা, অভিজ্ঞতা ও তার ব্যাখ্যা । সেটা রং , ধ্বনি, গন্ধে ধরা হয়েছে "একটি অংশত ভেনচারের খসড়া" গদ্যে । আমার কাছে এইটি গদ্যটি  বই থেকে সেরা পাওনা । এখান থেকেই আমি নিজেকেও খুঁজে পাচ্ছিলাম । অসংখ্য ধন্যবাদ । চেতনাপ্রবাহেও খানিকটা বোধহয় বয়ে গেলাম । আমি হয়তো অতটা কবি নই তবে কবিতাবিষয় কনটেন্টেও সম্পূর্ণ মেসমোরাইজড করে পড়িয়ে নিলো প্রদীপ চক্রবর্তী । মনে হচ্ছিলো কোন গোয়েন্দা গল্প পড়ছি । আর খুনি যতই তার সুরাগ মুছে ফেলে , গোয়েন্দা ততই তার চিন্তাজাল ছড়িয়ে দেন  আর মননের আতস কাঁচে তা ম্যাগনিফাই করে ফেলেন । এইতো হলো রুল অব দা গেম । 

No comments:

Post a Comment