Saturday, May 27, 2017

গড়দূরত্বের স্বরলিপিঃ সঞ্জীব নিয়োগী

পাঠকামি -১৯


ডাকে আসা বইগুলোর প্রতি আমার একটু তাড়াহুড়ো থাকে পড়ার  । আর এই দূর দিল্লিতে থাকার কারণে বাংলা বই তেমন পাওয়া যায় না । যা কিছু পাওয়া যায় সব ওই 'বিখ্যাত' কবি বা 'পুরস্কার' প্রাপ্ত বই না বলে যেগুলো  বাংলা বইয়ের দোকান এখানে আছে আছে , তারা রাখে না । আর বাংলা বই সংগ্রহ মানে লিটল ম্যাগ বা বইমেলায় গেলে পর । তাও ব্যাগ ব্যাগেজের কারনে , বোঝা বেশী ভারী করা যায় না । এই মত অবস্থায় কুরিয়ার বালা দরজায়  এলেই আজকাল মনে হয় কেউ বই পাঠিয়েছে । আজকের বই- একটা কবিতার বই, যে কবির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়  নেই বা দেখা সাক্ষাৎ হয় নাই ।

গড়দূরত্বের স্বরলিপিঃ সঞ্জীব নিয়োগী

কবিতার বই আমি আগোগোড়া স্ক্যান করি না । হয় শেষ কবিতা আগে পড়ি কিংবা প্রথমটা প্রথম । বইটার কবিতাগুলির নামকরণ নেই । টাইটেল লেস ।

"কুয়াশার মাঝরাত ভেতরে ভেতরে পাকা ধান । অঘ্রানের পরবের দিকে নিয়ে গ্যালো , খুব ভাত খাওয়া হবে রাতদিন জেগে জেগে..."  - (পাতা-৭) ।

কবিতার বিষয় বস্তু যেখানে ক্ষীণ হয়ে আসে , স্ট্রাকচার জায়গা করে নেয়, ঐটাই প্রধান হয়ে আসে । ধান পাকুক বা না পাকুক অঘ্রাণ চলে আসে । সেই কবিতায় কোন নামকরণ মাইনা রাখে না ।


গ্রামে জন্ম ও বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জেনেছি চুনোপুঁটির কি মানে হয়, আর বোয়ালের জ্যাবড়া কি জিনিস, এর সঙ্গে ছোট নোট আর বড় নোটের মেটাফর ও যেতে পারে , আসলে , কথা কি,  কোন সময়ে দাঁড়িয়ে কোন কথাটা বলা জরুরী, কিভাবে সাধারণ জীবন থেকে গল্প উঠে আসে, সেই ক্রেডিট লেখকেরই প্রাপ্য । 

"অথচ ভালো ভালো শব্দ তো বেশী থাকেনা, গালে হাত বুলোও বা গোলাপ চারায়..." (পাতা-৮) ।

ভালো কবিতার লাইমলাইট নিয়ে যায় আলোকিত সজ্জা, শব্দ ও ছন্দঝংকার । কবির সাধ আহ্লাদ সেখানে গৌন । কেউ যেন বলেছিলো , আমায় নহে গো, ভালোবাসো , শুধু, ভালোবাসো মোর গান । এখন কবিতায় আপনি কি নেবেন ? শব্দ নাকি ছন্দ নাকি গল্প । ভাববাদী ও অলংকারবাদীদের মধ্যে যতই অঘোষিত যুদ্ধ হোক এই কবিতাই নিয়ে আসে আসল উপলব্ধি । গোলাপের চারায় হাত রাখার উপলব্ধির কথা বোধ হয় পাঠক কোনদিন জানতে পারেন না ।

"জেগে জেগেই স্বপ্নগুলোকে মাত্রা আর লাগাম দিতে দিতে অনেকবারই বক্তব্যের দিকে স্পষ্ট ভাবে হেঁটেছে" - (পাতা-১৪) ।

কবিতাগুলো যখন পড়ি । অনেক সময় বাই ইনটিউশন একটা মানে করার প্রবনতা থাকে । এটা আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় । যখন লিখি , শুরুর দিকে তাই থাকে, পরে তার গন্তব্য পালটে যায়, এবং এই যাত্রা নিয়ে পরে যদিও কোন আপসোস থাকে না । কবিতার মাত্রা আর মানে তাই একটা নির্দিষ্ট দিকে যেতে চায়, অন্তত একটা মানে তো দাঁড়াবার কথা । এইখানে হলো মজার কথা । ল্যাঙ্গুয়েজ । কি ভাষায় কবিতাটা লেখা হয়েছে । যেহেতু বাংলাও একটি ভাষা, তাই ঐটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়ে যায় । কবিতারও যে নিজস্ব একটা ভাষা আছে , আর ঐ টা গুলিয়ে যায় । এই খানে লক্ষ্য করার মতো হলো যে 'কার দরকারটা বেশী' । কবির, 'কবিতা বোঝানোর' নাকি পাঠকের 'কবিতা বোঝার' ? বক্তব্য তো একটা রাখতেই হয় ।


তাহলে বাংলা কবিতার আর কি দাঁড়িয়ে থাকলো ? ভাষাটাই যদি না থাকবে, কিছু তার অর্থ ? কি হবে তার বিষয়-আশয় ? এই সব গল্প, কাহিনী আর ছন্দের কোন দাম নাই ?

"অনেক দাম চুকিয়ে আগলে রেখেছ সামান্য ধ্বংসপ্রায়...সহজেই ভুল বুঝোনা, উহ্য থাক ক্রিয়াপদের সরলীকরণঃ এই সাধারন , সমানুপাতিক গা-গতর , কথা শোনো , এমন কোন পতন তোমার ঘটেনি "  (পাতা-১৬)।

এর কি অর্থ হবে ? এই যেন নিজেরই বোধ, নিজেরই কবিতা উঠে আসে । আগেই বলেছি, বক্তব্যতো একটা থাকবেই, আর যেহেতু তাতে কোন ধামাকা নেই, এই সাধারণ কথা দিয়ে আর কতকাল অসাধারণ হবার প্রতিছবি হয়ে থাকবো ? এই কবিতার কি অর্থ । আমি অর্থ মানে টাকা পয়সা , খ্যাতি, যশ, ব্যাংক ব্যালান্স বুঝি ।

কবিতা পড়তে গিয়ে দেখেছি বিস্তর মাঠ পড়ে আছে, নানান ধরনের ফসল ফলানোর জমি । নানার ধরনের রসের আনাগোনা । আসলে দিনের শেষে কবিতা একটা শিল্পই । শিল্পী হিসাবে আপনি কতটা ফাইন করে তুলতে পারেন এইটা আপনার পরীক্ষা । তাতে আপনি যাই করেন ওটা কবিতাই । হারমোনিয়াম পেড়ে ফেলে দুলাইন গলা খাকারি দিলেও ওটা গানই । এর জন্য আপনার তিন তাল বা  দশ তাল না জানলেও চলে আর সাইত্রিশতম রাগীনির খোঁজ না পেলেও । মৌলিক বা যৌগিক এই নিয়ে যোগীরা তো তোলপাড় করে ফেলছে গোটা সোসাল মিডিয়া আর কবি সঞ্জীব নিয়োগী তখন লিখছেন ।

"তেত্রিশ কোটি চুমু পার হয়ে সন্ধ্যা মানে উচ্ছাসের, উচ্ছিষ্টের, সন্নাসের গান । এই যে চাবির মতো কিছু একটা শুয়ে থাকছে অন্তরালময়। তাকে একটু সহজ শরীর খুঁজে দাও" (পাতা-২৭)।

এই খানে 'উচ্ছিষ্ট' কথাটা এমন ভাবে উঠে আসছে, মনে হচ্ছে অপবিত্র হয়ে যাচ্ছে সমস্ত ঈশ্বরীয় চিন্তা ভাবনা আর চর্চিতচর্বনের শিল্প কলা । আর সন্তানের জন্ম দিতে দিতে একদিন সমস্ত শিল্পীরা ক্লান্ত হয়ে আসে, সমস্ত পুরুষমহিলা কবিরা লিংগ নির্বিশেষে মা হয়ে ওঠেন । তখন আর একটা জন্মের জন্য তাদের একটা শরীর দরকার হয় ।

কবিতাতো পাঠ করতেই হয় । পাঠের ভিতর কবিতা লুকিয়ে থাকে । তাকে খুঁজতে হয় ।  মাস্টারি চলে না । বোধের ভিন্নতায় নানান ব্যাখ্যা হয় । কিছুটা কবির সঙ্গেও মিলে যায়, কখনো মেলে না । রসের তারতম্য, বোধের ভিন্নতা সরিয়ে একটা ব্যাপার ফাইন হয়ে ওঠে । তরঙ্গ ছুটতে থাকে । পোয়েম ইস আল এবাউট এ মেটাফর ।

"কিছুক্ষন এই ভাবে থেকে বডি মিহি আইরনির তোয়াক্কার পাশেঃ বারবার পিছলে যায় গুনোত্তর প্রগতির করতলের মতো, উপমা খুঁজতে সকালগুলো গুটি গুটি ক্রমশ পুতুল..." (পাতা-৪২)।

এই ভাবে চলতে থাকে কবি, সরলরেখা বরাবর মেদহীন হেঁটে চলা । উপমার ব্যবহার স্থবীর করে দিয়ে কবির ভাষা ক্রিয়াপদ হীন হয়ে আসে । ক্রমশ । কবিতার চলনে কোন ক্যাট ওয়াক নেই বরং সোচ কা বিচার বা পরিধান বিশেষ উল্লেখ্য । কতটুকু পরলে কোমর দেখা যায় আর কতটুকু পরলে নিতম্ব বেরিয়ে আসে । জিরো ফিগার বেরিয়ে পড়ে কবিতার আলোকময়  চিত্রনাট্যে  ।

কবিতা পাঠ করে আমার কেমন লাগলো ? এক কথায় তান্দুরীর মতো । কামড় বসালে ক্রিস্পি ও কাঠের পোড়া গন্ধ আসে , মাংসের ভিতরে প্রোটিনের আধিক্য নজরে আসে সেখানে ব্রাস মেরে ফ্যাট বাটার লাগাতে হয় । আর স্বাদ তো নিজের মত করেই নিতে হয় । জিভেই কোন রক্ত না লেগে থাকাই সভ্যতার ঝলক । কবিতা সেখানে একটা উপস্থিতি মাত্র , কবি জানাতে চান তার নিজস্ব একটা অবস্থান বাংলা কবিতায় আছে ।

"বুঝতে পারছ উপস্থাপনার ছায়া, ডাক দিচ্ছে সক্রিয়তার ঢেউ । চাঁদ চাঁদ টী নিষ্ক্রিয় কপাল কপালে নিশাচর গোপনের হাসি আর প্রক্ষিপ্ত উপকাহিনীর নির্ভর পান্ডুলিপি" (পাতা ৪৫) ।

আমার পাঠ আজ এই পর্যন্তই থাকলো । নিজস্ব বোধ ও ভাবনা নিয়ে এই পাঠ আগামীতেও চলতে থাকবে । এই পাঠ এবং এর থেকে উঠে আসে আমার ভাবনা , এ আমার নিজস্ব ও আপেক্ষিক । এর কোন বানিজ্যিক মূল্য নেই, বা প্রকাশযোগ্যতাও । মূলত, এই বিদেশে বসে যেটুকু বই পাই তাদের দাম চুকানোর সাধ্য আমার নেই বা সুযোগও থাকে না । সেইটুকু ধন্যবাদ জ্ঞাপন অন্তত আমার এই পাঠকামিতে থাক । এই কবিতা নিয়ে খেলতে থাকা ব্যস্ত কবিদের কপালে চাঁদমামা টী দিয়ে যাক । 

No comments:

Post a Comment