Sunday, May 21, 2017

ফিসফাস কিচেনঃ সৌরাংশু

পাঠকামি -১৮

দিল্লিতে অনেকদিন আছি । নানান ভাবে বাংলা সাহিত্যের নানান উদাহরণ সামনে এসে যায়, তাদের কোনটা পড়তে পড়তে মনে হয় এই দিল্লির সাহিত্যযাপন এক অনন্যসুন্দর ও একান্ত আপন । চাকরিসূত্রেই আসা এই দিল্লি কখন যে এইভাবে আপন বুকে টেনে নেয় আমরা দিলবালা হয়ে উঠি । এইভাবে সৌরাংশুর সঙ্গে কোন ভূমিকা ছাড়াই একদিন পরিচয় হয় দিল্লির বাংলা বইমেলায়, নিউদিল্লি কালিবাড়ীতে । সাহিত্যের কারনেই তার কিছু লেখা যা খানিকটা রম্যরচনা বলে পরিচিত, তার পরিচয় হয়েছিলো ফিসফাসের মাধ্যমে । ফিসফাস ১ , ফিসফাস ২ । যা বের হয়, সব মুড়িমুড়কির মত বিক্রি হয়ে যায় । সেইভাবে কোনদিন পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখিনি । পড়েছি, এবং দিল্লির বাঞ্জরভূমিতে বসে এই সাহিত্যচাষের প্রতিসাক্ষী হতে হতে একদিন হাতে চলে এলো কিচেন ফিসফাস । আজকের বই ।

ফিসফাস কিচেনঃ সৌরাংশু ।

বইটার কোন সূচীপত্র নেই । তো জাহির হে, যখন খানা খাবারের কথা চলছে, ডেফিনিটলি সেখানে মেনুতেই সজ্জিত হয়ে উঠে খাবারের সুগন্ধী তালিকা । মেনু আর সূচি একই জিনিস । মনোরম খাদ্যের অপরুপ সৌন্দর্য্যে জল চলে আসবে জিভেই আর পড়তে গেলেই মস্তিষ্কের কোষে কোষে সৌরভে ভরে উঠবে কল্পনার রেসিপি । ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যাবে এই পাতার পর পাতা, খাবারের কাল্পনিক রসে টইটম্বুর হয়ে উঠবে পাঠকের মন, এইখানে আসে গল্প বলার শৈলী, আর তথ্য আর ইতিহাসের সামঞ্জস্য । খাদ্যের জনপ্রিয়তা আর তার সময়জ্ঞান হিসাবে বিভিন্ন পর্য্যায়ক্রমে সান্ধ্য আড্ডা, ভূরিভোজন, দেশেবিদেশে ও মিস্টিমুখে সৃষ্টিসুখে অধ্যায়গুলিতে একের পর এক কিচেনের গল্প পরিবেশন করে চলেছেন এই বইতে । মান্নাদের সেই গানটা মনে করিয়ে দিচ্ছে । 

"আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না / ইস্তাম্বুল গিয়ে / জাপান, কাবুল গিয়ে  / শিখেছি সহজ এই রান্না ।।  হাতে নিয়ে ডেকচি,/ যেই তুলি হেঁচকি / বিরিয়ানী কোরমা,/ পটলের দোরমা, মিলেমিশে হয়ে যায় 
প্যারিসের ছেঁচকি ...... আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না / খাইবার পাস গিয়ে / রোম , সাইপ্রাস গিয়ে / শিখেছি দারুণ এই রান্না " 

আসলে কিচেনে সবাই একটু আধটু যায়, কেউ চা বানায়, কেউ অমলেট বানায়, কেউ এক গ্লাস জল ভরে নিয়ে এসে খায় । অনেকে আবার গর্বও করেন তার এই পর্যন্তই 'দৌড়' । আবার অনেকে মেয়েদের কাজ বলে 'খুন্তী নাড়া থেকে' দূরেই থাকেন । কিন্তু এই ব্যাপারে আমি জানি সৌরাংশু নিজেই রান্নার ব্যাপারে মস্ত বড় উস্তাদ , রান্নায় আলদা ইন্টারেস্ট ব্যক্তিগত জীবনের অঙ্গ । তার তার এই কথায় কথায় রোম সাইপ্রাস ভ্রমনে একবার বেরিয়ে পড়া যাক ।

যে কোন লাঞ্চ বা ডিনারের মতই তার গল্প শুরু হয় স্টার্টার দিয়ে । চা , সিঙ্গাড়া জলপানের গল্প দিয়ে কিছুটা ইতিহাস ঘুরে আসি । নানান ভূগোলের কথা, দিল্লির চায়ের কথা চলে আসে । চা নিয়ে কোন লেখক কি করেছে, কার গল্পকারের গল্পে কি কিসসা আছে, এই তে বোঝা যায় সৌরাংশু গল্পে একটু সাহিত্যরস নিয়ে আসতে চাইছে । সিঙ্গাড়া নিয়েও চলে আসে আর একগল্পে । নানান দেশের সিঙ্গাড়া আর তার জনমকুন্ডলী খুলে দেখিয়ে দেন কোন দেশে সিঙ্গাড়া কি নাম পরিচিত । যেখানে অবশ্য সৌরাংশু এই রহস্যের সমাধান করেন না যে সিঙ্গাড়ার ভিতর আলু ঢুকলো কি করে ।   

এর পর আসে কফির জগৎ । এই কফিটা একটু বিশেষ মনোযোগ দিয়ে পড়লাম । একবার শুনেছিলাম কফির রাজা স্টারবাক্‌স নাকি কফিতে ড্রাগ মেশায় । কিন্তু সেই খবর পেলাম না কোথাও । যথারীতি সেই ইতিহাস ও ভূগোল । আর ফের সেই মান্নাদে । কফিহাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই । এই টুইস্টগুলোর কারনে লেখাগুলোর পাঠযোগ্যতা বাড়ে । আড্ডা চলতে থাকে ।

ভূরিভোজনের বিরিয়ানীর রান্নার ও রকমভেদ বেশ উল্লেখযোগ্য ও তথ্যনির্ভর । যেভাবে প্রতিবার ইতিহাস ও ভূগোল উঠে আসে, এই বার তার সঙ্গে জুড়ে যায় নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী । লক্ষনৌ , হায়দ্রাবাদী নিয়ে আলাদা আলোচনা । মনে হচ্ছে একদিন খুন্তী কড়াই নিয়ে বসেই পড়বো । ইলিশ চিংড়ি নিয়েও আলোচনা আছে, কিন্তু ছ্যাঁচড়া-চচ্চড়িটা বিশেষ আকর্ষন কাড়ে । কেউতো আজকাল নেমতন্ন করে এই খাবার খাওয়ায় না । খাওয়ার ব্যাপারে বাঙাল আর ঘটিদের আলাদা রকমের পছন্দ ও মারামারি তো আছেই। যেটা আমার সন্দেহ হচ্ছে এই লেখক প্রচন্ড ভাবে মোহনবাগানীয় মনোভাবের আর বড্ড ঘটি পাশঘেষা । এইকারণে আলু, আলু-পোস্ত নিয়ে দুচারটি লেকচার ঝাড়বেন না তা হয় কি ? পোস্তর নানান ইতিহাস ভূগোল তাই থাকবেই । সুতরাং অবসম্ভাবী ভাবে চলে আসে 'দেশে-বিদেশে' অধ্যায় । মিশন কাশ্মীর নিয়ে শুরু । এটা আমার প্রথম চাকরী পর্বত শহর জম্মুর কথা মনে পড়িয়ে দিলো । এর পরেই আসে দক্ষিনী আমিষের কথা । সেকথা বেশী না বলাই ভালো । একবার এক মাদ্রাজীর বাড়িতে মাছের ঝোল খেয়ে হুস হাস করেছিলাম । তিনদিন ভাত খাইনি । বাপরে বাপ কি সেই ঝোল । তেতুলগোলা দিয়ে লঙ্কার বাঁটার ঝোল ! অবশ্য পরের লেখাটি বেশ মজাদার । সিলেটি রান্নার কথা একটু রসিয়েবসিয়ে বলা হয়েছে ।  এরপর আসে মিস্টির কথা, চকোলেটের কথা । ডায়াবেটিসের যুগে সাবধানে থাকা ভালো । নানান রকমের পিঠে পায়েসের লোভ ধরিয়ে দিয়ে এই পাঠ সমাপ্ত করলাম । 

পাঠ বলতে আমি বেশী কল্পনা মিশ্রিত নিমগ্ন পাঠের পক্ষপাতি । সেই কারনে কবিতা ও কবিতা বিষয়ক লেখা পড়তে বেশী ভালোবাসি । সেখানে একটা 'ফাইন' বলে একটা ব্যাপার খুঁজি । যে কারনে আমি নাটক ও দেখি, ক্রিকেট খেলাও দেখি, একটা 'ফাইন' মোমেন্ট দেখার অপেক্ষা থাকে । মোটা করে বললে একটা ব্লকবাস্টার মোমেন্ট ও বলা যায় । গল্প ও কাহিনীতে আমি যেটা খুঁজি সেটা হলো ভাষার বিবর্তন, কল্পনার মিশ্রন, লেখকের নিজস্ব টাচ । কে কিভাবে বলল কথাটা । কি বিষয় আর কি বিশেষ্য আর কি তার ক্রিয়াপদ । গদ্য পড়তে আসা শুধু মাত্র তথ্যের সন্ধানে নয়, সেখানে তার নিজের বাগ্মিতা, যোগ্যতা, পড়াশোনা, রিসার্চ, অনুসন্ধান, দূরদৃষ্টি নানান বিষয় আমার খোঁজে থাকে । গানও এইকারণে শুনি । আর এই বাজারে এত কন্টেন্ট, আর তা এত সহজলভ্য যে তার পাঠ যান্ত্রিকতার দিকে নিয়ে যায় । তারপর নানান জ্ঞান আর সোসালমিডিয়া, কেবলটিভি সমস্ত জ্ঞানগম্ভীর আলোচনা এত তার্কিক হয়ে উঠেছে যে পাঠ ও ক্রমাগত পাঠ্যতা রীতিমত হিমসিম খেয়ে উঠছে । ইন্টারনেট খুললেই যে কোন রেসিপি বা যে কোন খাদ্যের বিবরণ যদি চটজলদী পাওয়া যায় তবে এই বাজারে বসে একজন পাঠক কেন ফিসফাস কিচেন পড়বেন ? 

সেইটা হলো সাহিত্যের চ্যালেঞ্জ, বাংলা সাহিত্যের চ্যালেঞ্জ যেটা সৌরাংশু তুলে নিলেন বৈঠকী কায়দায় । ব্লগের ভাষায় । সুক্ষ্নতা আর অধ্যাবসায়ের মধ্য দিয়ে এই বিশেষ কায়দা ও দক্ষতার সহিত ভাষার বিভিন্ন আঙ্গিক সৌরাংশু কিভাবে পরিবেশেন করেছেন তা জানতে হলে হাতে তুলে নিতে হবে ফিসফাস কিচেন ।


বইঃফিসফাস কিচেন (১ ম পর্ব ) । লেখকঃ সৌরাংশু । প্রকাশকঃ একটি সৃষ্টিসুখ প্রয়াস । মূল্যঃ ভারতীয় মুদ্রা ২২৫ টাকা মাত্র ।  
  

No comments:

Post a Comment